পর্দার আসল রুপঃ
১. মহিলারা প্রয়োজনে ভিন্ পুরুষের সাথে কথা বলবেন কিন্তু মিহি স্বরে বলবেন না।
আল্লাহ বলেন, ‘ওহে নবীর স্ত্রীরা তোমরা তো অন্য কোন মহিলার মতো নও, তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় কর তাহলে ( ভিন পুরুষের সাথে কথা বলার সময়) মিহি স্বরে কথা বলো না যা অন্তরে ব্যাধি আছে এমন লোককে প্রলুব্ধ করবে এবং (সর্বদা) সংগত কথা বলবে।’ (আল আহযাব:৩২ )
ইসলাম মহিলাদেরকে প্রয়োজনে ভিন পুরুষের সাথে কথা বলার অনুমতি দিয়েছে। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ(সা:) বহু পুরুষের কাছে দ্বীনি বিষয় বর্ণনা করেছেন।
কিন্তু প্রয়োজন নেই এমন ক্ষেত্রে মহিলাদের কণ্ঠস্বর ভিন পুরুষকে শুনানো অপছন্দ করা হয়েছে। সেই জন্যই মহিলাদেরকে আযান দিতে দেয়া হয়নি। সালাতে ইমাম ভুল করলে পুরুষদেরকে আল্লাহু আকবার” কিংবা “সুবহানাল্লাহ” উচ্চারণ করে লোকমা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু মহিলাদেরকে বলা হয়েছে হাতের উপর হাত মেরে শব্দ সৃষ্টি করে লোকমা দিতে। উপরোক্ত আয়াতটি পর্দার বিধান সংক্রান্ত অনেকগুলো আয়াতের মধ্যে প্রথম আয়াত। এই আয়াত ও পরবর্তী আরো কয়েকটি আয়াতে রাসুলুল্লাহ(সা) স্ত্রীদেরকে সম্বোধন করে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য হচ্ছে সকল মুসলিম পরিবারের সংশোধন। নবীর (সা) স্ত্রীদেরকে সম্বোধন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে যখন নবীর ঘর থেকে এই পবিত্র জীবন ধারার সুচনা হবে তখন অন্য সকল মুসলিম পরিবারের মহিলারা আপনা আপনি তা অনুসরণ করতে থাকবে। কারণ এই ঘরই তো ছিলো তাঁদের জন্য আদর্শ ঘর।”
২. মহিলাদের কর্তব্য হচ্ছে গৃহাংগনেই অবস্থান করা, সাজ–সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়ানো নয়।
আল্লাহ বলেন, “তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থান কর, পূর্বতন জাহিলিয়াতের ধাঁচে সাজ-সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়িয়োনা। সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে চল। আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে নবী পরিবার থেকে ময়লা দূর করতে ও তোমাদেরকে পুরোপুরি পাক-পবিত্র করতে।” ( আল আহযাব : ৩৩)
“আল্লাহ মহিলাদেরকে যেই কার্যধারা থেকে বিরত রাখতে চান তা হচ্ছে, তাদের নিজেদের সাজ-সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করে ঘর থেকে বের হওয়া। তিনি তাদেরকে আদেশ দেন, নিজেদের ঘরে অবস্থান কর। কারণ তোমাদের আসল কাজ রয়েছে ঘরে, বাইরে নয়। কিন্তু যদি বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে এমনভাবে বের হয়োনা যেমন জাহিলী যুগে মহিলারা বের হতো। প্রসাধন ও সাজ-সজ্জা করে সুশোভন অলংকার ও আটসাট বা হালকা মিহিন পোশাকে সজ্জিত হয়ে, চেহারা ও দেহের সৌন্দর্য উন্মুক্ত করে, গর্ব ও আড়ম্বরের সাথে চলা কোন মুসলিম সমাজের মহিলাদের কাজ নয়। এই গুলো জাহেলিয়াতের রীতিনীতি। ইসলামে এই সব চলতে পারে না।”
৩. কোন মহিলার কাছে কিছু চাইতে হলে পর্দার আড়াল থেকে চাইতে হবে।
“এবং যখন তাদের কাছে (নবীর স্ত্রীদের কাছে) কিছু চাইতে হয় তা চাও পর্দার আড়াল থেকে। এটি তোমাদের ও তাদের মনের জন্য পবিত্রতম পদ্ধতি।”
এই নির্দেশ আসার পর নবীর (সা) স্ত্রীদের ঘরের দরজায় পর্দা লটকিয়ে দেয়া হয় । আর যেহেতু নবীর (সা) ঘর ছিলো সকল মুসলিমের জন্য আদর্শ ঘর তাই সেই ঘরের অনুকরণে তারা নিজেদের ঘরের দরজায় পর্দা লটকিয়ে দেন।
৪. মহিলাদের ঘরে তাঁদের আব্বা, তাঁদের ছেলে, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, ঘনিষ্ঠ মহিলারা ও মালিকানাধীন ব্যক্তিরা (দাস দাসী) প্রবেশ করতে পারবে।
“তাদের আব্বা (চাচা, মামা, দাদা, দাদার আব্বা ,নানা, নানার আব্বা শামিল), তাদের ছেলে, (নাতি, নাতির ছেলে দৌহিত্র.ও দৌহিত্রের ছেলে শামিল), তাদের ভাই (বৈপিত্রেয়, বৈমাত্রেয় ও দুধ ভাই শামিল),তাদের ভাইয়ের ছেলে (তাদের নাতি ও নাতির ছেলে শামিল), তাদের বোনের ছেলে (তাদের দৌহিত্র ও দৌহিত্রের ছেলে শামিল), তাদের ঘনিষ্ঠ (মেলামেশার) মহিলারা ও তাদের মালিকানাধীন ব্যক্তিরা তাদের ঘরে প্রবেশ করলে কোন দোষ নেই । তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, অবশ্যই আল্লাহ সবকিছু প্রত্যক্ষ করেন।” (আল আহযাব: ৫৫)
৫. মহিলারা তাদের পরিহিত জিলবাবের (বড়ো চাদরের) একাংশ তাদের চেহারার দিকে ঝুলিয়ে দেবেন।
আল্লাহ বলেন, “ওহে নবী তোমার স্ত্রীদেরকে, মেয়েদেরকে ও মুমিন মহিলাদেরকে বলে দাও তারা যেন তাদের জিলবাবের একাংশ নিজেদের (মুখমণ্ডলের) ওপর টেনে দেয় । এতে করে তাদেরকে চেনা সহজ হবে এবং উত্যক্তও করা হবে না।” (আল আহযাব:৫৯)
এই আয়াত জিলবাব পরিধানের নির্দেশ সম্বলিত আয়াত নয় বরং পরিহিত জিলবাবের একটি অংশ ওপর থেকে ঝুলিয়ে দেবার নির্দেশ সম্বলিত আয়াত। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, এই আয়াত নাযিলের পূর্বেই মুসলিম মহিলারা জিলবাব পরা শুরু করেছেন। আর যারা জিলবাব পরতেন তারা শুধু নবীর (সা) স্ত্রীরাই ছিলেন না, সকল মহিলাই এই কাজে শামিল ছিলেন। “নিসাইল মু’মিনীন” বলে তাদেরই কথা উল্লেখ করা হয়েছে এই আয়াতে। এই আয়াত আরো প্রমাণ করে যে পূর্ববর্তী আয়াতগুলো নবীর (সা)স্ত্রীদেরকে সম্বোধন করে পর্দা সংক্রান্ত যেইসব বিধান নাযিল করা হয়েছে সেইগুলোও মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভূক্ত সকল মহিলার জন্যই প্রযোজ্য।
উল্লেখ্য যে পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পর মুসলিম মহিলারা জিলবাব পরিধান না করে ঘর থেকে বের হতেন না এবং জিলবাবের একাংশ দিয়ে তারা তাদের চেহারা ঢেকে পর পুরুষের দৃষ্টি থেকে হিফাযত করতেন। উম্মুল মুমিনীন আয়িশার (রাঃ) ছিলেন তাফসীরবিদ, হাদীসবিদ ও ফিকাহবিদ। আলকুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে তিনি অসাধারণ পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন। ইসলামী জীবন বিধানের অনেক কিছু মুসলিম উম্মাহ তার মাধ্যমেই জানতে পেরেছে। তার সম্পর্কে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,
‘‘পুরুষদের অনেকেই কামালিয়াত অর্জন করেছে । মহিলাদের মধ্যে তা অর্জন করেছেন মারইয়াম বিনতু ইমরান ও ফিরআউনের স্ত্রী আসিয়া। আর যাবতীয় খাদ্যের ওপর যেমন সারীদের (এক প্রকার উৎকৃষ্ট ও সুস্বাদু খাদ্য) মর্যাদা, সকল নারীর ওপর তেমন মর্যাদা আয়িশার।”
আবু মূসা আল আশয়ারী (রা), (সহীহ আল বুখারী)
এই নারীশ্রেষ্ঠা আয়িশা(রা) তার পরিহিত জিলবাবের একাংশকে নিকাব বা চেহারার আবরণ বানিয়ে নিতেন।
বানুল মুস্তালিক যুদ্ধ শেষে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় ফেরার পথে এক মানযিলে সৈন্যদেরকে নিয়ে বিশ্রাম করেন। সেই সফরে উম্মুল মুমিনীন আয়িশা(রা) তাঁর সাথে ছিলেন। বেশ রাত থাকতেই কাফিলা সেখান থেকে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এই সময় আয়িশা(রা) প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারার জন্য একটু দূরে যান। প্রয়োজন সেরে হাওদাজে ফিরে এসে দেখেন তাঁর হার গলায় নেই। হার খুঁজতে তিনি হাওদাজ ছেড়ে চলে যান। এই দিকে কাফিলা রওয়ানা হয়ে যায়। লোকেরা তাঁর হাওদাজ উটের পিঠে বসিয়ে দেয়। কিন্তু তারা টেরই পায়নি যে তিনি হাওদাজে বসা নেই। কাফিলা চলে গেলে তিনি এ স্থানে ফিরে এসে বসে পড়েন । কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। সাহাবী সাফওয়ান ইবনু মুয়াত্তাল আস্সুলামী (রা) সৈন্য বাহিনীর পেছনে রয়ে গিয়েছিলেন। তিনি রাত্রি শেষে রওয়ানা হয়ে সকাল বেলা ঐ স্থানে এসে পৌঁছেন যেখানে আয়িশা (রা) ঘুমিয়ে ছিলেন। পরবর্তী ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আয়িশা (রা) বলেন, “তিনি আমাকে দেখেই চিনে ফেলেন । কারণ পর্দার বিধান প্রবর্তনের পূর্বে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। আমাকে চিনতে পেরেই তিান বিস্মিত হয়ে উচ্চারণ করেন“ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন”। তার কণ্ঠস্বর আমার কানে যেতেই আমি জেগে উঠি ও আমার চাদর দিয়ে আমার চেহারা ঢেকে ফেলি।” (সহীহ মুসলিম, সহীহ আলবুখারী, মুসনাদে আহমদ)
৬. কেউ গৃহবাসীদের সম্মতি না পেয়ে ও তাদেরকে সালাম না জানিয়ে কারো ঘরে প্রবেশ করবেন না।
আল্লাহ বলেন, “ওহে যারা ঈমান এনেছো, নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কারো ঘরে গৃহবাসীদের সম্মতি না পেয়ে ও তাদেরকে সালাম না জানিয়ে প্রবেশ করোনা। এটি তোমাদের জন্য উত্তম বিধান। আশা করা যায় তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে।” (আন নূর:২৭)
৭. গৃহে কাউকে না পেলে বিনা অনুমতিতে অন্যের ঘরে প্রবেশ করবেন না।
আল্লাহ বলেন, “সেখানে কাউকে না পেলে বিনা অনুমতিতেই তাতে প্রবেশ করো না।” (আন্ নূর:২৮)
৮. গৃহবাসীদের পক্ষ থেকে যদি বলা হয়, “এখন চলে যান ” চলে আসতে হবে।
আল্লাহ বলেন, “আর যদি তোমাদের বলা হয় ‘এখন যান’ তাহলে ফিরে যাবে । এটি তোমাদের জন্য বিশুদ্ধ নীতি। আর তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ্ তা ভালভাবেই জানেন।”
(আন নূর:২৮)
৯. লোক বসবাস করেনা এমন ঘরে কোন প্রয়োজনীয় সামগ্রী থাকলে তা আনার জন্য সেই ঘরে প্রবেশ করা যাবে ।
আল্লাহ বলেন“এমন ঘরে প্রবেশ করা তোমাদের জন্য দোষের নয় যেখানে কেউ বাস করে না অথচ সেখানে কোন প্রয়োজনীয় সামগ্রী রয়েছে। আর তোমরা যা কিছু প্রকাশ কর ও যা কিছু গোপন কর আল্লাহ সবই জানেন।”
১০. মুমিন পুরুষেরা তাদের দৃষ্টি সংযত রাখবেন ।
আল্লাহ বলেন, “ মুমিন পুরুষদের বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে ও লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। এটি তাদের জন্য বিশুদ্ধ নীতি । তারা যা কিছু করে আল্লাহ্ তা জানেন।” (আন্ নূর:৩০)
আপন স্ত্রী কিংবা কোন মুহাররাম মহিলাকে ছাড়া অপর কোন মহিলাকে নজর ভরে দেখা কোন পুরুষের জন্য জায়েয নয়। একবার নজর পড়া ক্ষমাযোগ্য। আবার নজর দেয়া ক্ষমাযোগ্য নয়। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) এই ধরনের দেখাকে চোখের যিনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, “মানুষ তার ইন্দ্রিয় গুলোর মাধ্যমে যিনা করে থাকে। দেখা হচ্ছে চোখের যিনা। ফুসলানো কন্ঠের যিনা। তৃপ্তির সাথে পর নারীর কথা শুনা কানের যিনা। হাত দ্বারা স্পর্শ করা হাতের যিনা। অবৈধ উদ্দেশ্যে পথচলা পায়ের যিনা। যিনার এই সব অনুসঙ্গ পালিত হওয়ার পর লজ্জাস্থান তাকে পূর্ণতা দান করে কিংবা পূর্ণতা দান করা থেকে বিরত থাকে”। (সহীহ মুসলিম, সহীহ আল বুখারী,সুনানু আবী দাউদ)
উল্লেখ্য যে কোন কোন তাত্তি¡ক ব্যক্তি উপরি উক্ত আয়াতটিকে সামনে রেখে বলতে চান যে যদি চেহারা খোলাই না থাকে তাহলে এই আয়াতটি অর্থহীন হয়ে পড়ে। মহিলাদের খোলা রাখার অনুমতি আছে বলেই পুরুষদেরকে দৃষ্টি সংযত রাখতে বলা হয়েছে । তারা তাদের বক্তব্যকে শক্তিশালী করার জন্য বিদায় হজ্জ্বের সময়ে সংঘটিত দুইটি ঘটনাকেও তাদের পক্ষে ব্যবহার করার প্রয়াস চালান । প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, মহিলারা তাদের চেহারা ঢেকে রাখবেন বটে, কিন্তুু তাদের চোখ তো আবরণমুক্ত থাকবে । ফলে চোখাচুখির ব্যাপার ঘটতে পারে। তদুপরি অমুসলিম মহিলারা তো তাদের চেহারা খোলাই রাখবে । অতএব দৃষ্টি সংযত রাখার নির্দেশ অবশ্যই অর্থহীন নয়। বিদায় হজ্জ্বের সময় সংঘটিত ঘটনা দুইটি এই ভাইদের বক্তব্য শক্তিশালী করে না। বরং তাদের বিরুদ্ধে বুমেরাং হয়।
প্রথম ঘটনা
“বিদায় হজের সময় নবীর (সা) চাচাতো ভাই আলফাদল ইবনুল আব্বাস (তিনি তখন একজন উঠতি-তরুণ) মাশআরুল হারাম থেকে ফেরার পথে নবীর (সা) সাথে উটের ওপর বসা ছিলেন। পথে মহিলারা যাচ্ছিলো। আলফাদল তাদেরকে দেখতে থাকলেন। নবী (সা) তার মুখের ওপর হাত রেখে অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন।” জাবির ইবনু আবদিল্লাহ (রা), (সুনানু আবী দাউদ)
দ্বিতীয় ঘটনা
“আল খাসয়াম গোত্রের একজন মহিলা পথে রাসূলুল্লাহকে (সা) হজ্জ্ব সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন করেন । আলফাদাল ইবনুল আব্বাস (রা) এক দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকিয়ে থাকেন। নবী (সা) তার মুখ ধরে অন্য দিকে ফিরিয়ে দেন।” (সহীহ আল বুখারী, জামে আত্ তিরমিযী, সুনানু আবু দাউদ)
নবী (সা) দুইবারই উঠতি তরুণ আলফাদল ইবনুল আব্বাসের মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন, কিন্তু মহিলাদেরকে তাদের চেহারা ঢেকে নিতে বলেননি।
কারণ
এর কারণ হচ্ছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইংগিতেই ইতোপূর্বে তিনি মহিলাদেরকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ইহরাম পরিহিত মহিলারা নিকাব পরবেন না । উপরি উক্ত ঘটনা দুইটিতে মহিলারা ছিলেন হজ্জ্বযাত্রী ও ইহরাম পরিহিতা । কাজেই আলফাদল ইবনুল আব্বাসের (রা) দৃষ্টির মুকাবিলায় তিনি তাদেরকে চেহারা ঢাকার নির্দেশ দেননি। লক্ষ্য করুন, ইহরাম পরিহিতা মহিলাদের সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, “ইহরাম পরিহিতা মহিলারা নিকাব পরবে না ও হাত মোজা পরবে না।” আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা), (সহীহ আল বুখারী)
আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, “ইহরাম পরিহিতা মহিলারা নিকাব পরবে না ও হাত মোজা পরবে না।” আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা), (জামে আত তিরমিযী)
“ইহরাম পরিহিতা মহিলা নিকাব পরবে না ও হাত মোজা পরবে না।” আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা), (সুনানু আবী দাউদ) ।
“তিনি রাসূলুল্লাহকে (সা) ইহরাম পরিহিতা মহিলাদের হাত মোজা, নিকাব, ওয়ারাস, ও জা’ফরান রঞ্জিত পোশাক পরিধান নিষেধ করতে শুনেছেন।”
১১. মুমিন মহিলারা তাদের দৃষ্টি সংযত রাখবেন।
আল্লাহ বলেন, “মুমিন মহিলাদের বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে।” (আন নূর:৩১)
উল্লেখ্য যে “মহিলাদের জন্যও পুরুষদের মত দৃষ্টি সংযত রাখার বিধান দেয়া হয়েছে । তবে পুরুষদেরকে দেখার ব্যাপারে তেমন কড়াকড়ি নেই যেমন কড়াকড়ি মহিলাদেরকে দেখার ব্যাপারে পুরুষদের ওপর আরোপিত হয়েছে । এক মজলিসে মুখোমুখি বসে দেখা নিষিদ্ধ। পথ চলার সময় কিংবা দূর থেকে কোন জায়েয খেলা দেখতে গিয়ে পুরুষদের ওপর দৃষ্টি পড়া নিষিদ্ধ নয়। আর কোন যথার্থ প্রয়োজন দেখা দিলে একই বাড়িতে থাকা অবস্থায় দেখলে কোন ক্ষতি নেই। তবুও মহিলারা নিশ্চিন্তে পুরুষদেরকে দেখতে থাকবে ও তাদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকবে, এটা কোনক্রমেই জায়েজ নয়।”
১২. মহিলারা ভিন্ পুরুষের সামনে তাদের সাজ– সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না। যা আপনা আপনি প্রকাশ হয়ে পড়ে তা ক্ষমাযোগ্য ।
আল্লাহ বলেন “তারা (মুমিন মহিলারা) যেন তাদের সাজ- সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তা ছাড়া যা আপনা আপনি প্রকাশ হয়।”(ইল্লা মা যাহারা মিন হা) আয়াতাংশের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মত পার্থক্য রয়েছে ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে। কেউ কেউ এই আয়াতাংশের যেই জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ পেশ করেছেন তা অসাধারণ। তিনি বলেন, “প্রকাশ হওয়া” ও “প্রকাশ করার” মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আমরা দেখি আল কুরআন “প্রকাশ করা” থেকে বিরত রেখে “প্রকাশ হওয়ার” ব্যাপারে অবকাশ দিচ্ছে।এই অবকাশকে “প্রকাশ করা ” পর্যন্ত বিস্তৃত করা আল কুরআনের বিরোধী এবং এমন সব হাদীসেও বিরোধী যেইগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে নবীর (সা) যুগে আলহিজাবের নির্দেশ আসার পর মহিলারা (চক্ষুদ্বয় ছাড়া) চেহারা খুলে চলতেন না, আলহিজাবের হুকুমের মধ্যে চেহারার পর্দাও শামিল ছিলো এবং ইহরাম ছাড়া অন্যান্য অবস্থায় নিকাবকে মহিলাদের পোশাকের একটি অংশে পরিণত করা হয়েছিল।”
১৩. মহিলারা তাদের উড়না দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখবেন ।
আল্লাহ বলেন,“এবং তারা যেন তাদের উড়নার আঁচল দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখে।” (সূরা আন্ নূর: ৩১)
১৪. মহিলারা তাদের স্বামী, তাদের আব্বা, তাদের শ্বশুর, তাদের ছেলে, তাদের স্বামীর ছেলে, তাদের ভাই, তাদের ভাইয়ের ছেলে,তাদের বোনের ছেলে,তাদের ঘনিষ্ঠ স্ত্রীলোক, তাদের মালিকাধীন ব্যাক্তি,কামনাহীন অধীন পুরুষ ও নারীদের গোপন বিষয় বুঝে না এমন বালকের সামনে ছাড়া তাদের সাজ সৌন্দর্য প্রকাশ করবেন না”
আল্লাহ্ বলেন, “তারা যেন তাদের সাজ সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের স্বামী,তাদের আব্বা,তাদের শ্বশুর,তাদের ছেলে,তাদের স্বামীর ছেলে,তাদের ভাই,তাদের ভাইয়ের ছেলে,তাদের বোনের ছেলে,তাদের ঘনিষ্ঠ স্ত্রীলোক,তাদের মালিকানাধীন ব্যক্তি, কামনাহীন অধীন পুরুষ ও নারীদের গোপন বিষয় বুঝে না এমন বালকের সম্মুখে ছাড়া।”
“এই সীমিত গণ্ডির বাইরে যারাই আছে তাদের সামনে মহিলাদের সাজ-সৌন্দর্য ইচ্ছাকৃতভাবে বা বেপরোয়াভাবে নিজেই প্রকাশ করা উচিত নয়,তবে তাদের প্রচেষ্টা সত্তে¡ও কিংবা তাদের ইচ্ছা ছাড়াই যা প্রকাশ হয়ে পড়ে কিংবা যা গোপন করা সম্ভব না হয় তা আল্ল্হার কাছে ক্ষমাযোগ্য।”
১৫. মহিলারা এমনভাবে পা মেরে চলবেন না যাতে তাদের লুকানো সাজ–সৌন্দর্যের কথা লোকেরা জেনে ফেলে।
“এবং তারা যেন তাদের পা এমনভাবে না মেরে চলে যাতে তাদের লুকানো সাজ-সৌন্দর্যের কথা লোকেরা জেনে ফেলে। আর মুমিনগণ, তোমরা সকলে আল্লাহর নিকট তওবা কর । আশা করা যায় তোমরা কল্যাণ লাভ করবে।”
১৬. মালিকানাধীন ব্যক্তি ও না–বালেক সন্তানেরা তিনটি সময়ে অনুমতি না নিয়ে গৃহকর্তা–গৃহকর্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করবে না।
আল্লাহ বলেন, “ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের মালিকানাধীন ব্যক্তি ও না-বালেক সন্তানেরা তিনটি সময়ে অনুমতি নিয়ে তোমাদের কাছে আসা উচিত : সালাতুল ফজরের আগে, দুপুরে যখন তোমরা পোশাক ছাড় ও সালাতুল ইশার পরে । এই তিনটি তোমাদের গোপণীয়তার সময়। অন্য সময় তারা তোমাদের কাছে এলে তোমাদের তাদের কোন দোষ নেই।” (আন্ নূর: ৫৮)
১৭. সন্তানেরা বালেগ হয়ে গেলে সকল সময় বড়োদের মতই অনুমতি নিয়ে আব্বা–আম্মার কক্ষে প্রবেশ করতে হবে।
আল্লাহ বলেন, “আর তোমাদের সন্তানেরা যখন বালেগ হয়ে যায় তখন তাদের তেমনি অনুমতি নিয়ে তোমাদের কাছে আসা উচিত, যেমন তাদের বড়োরা অনুমতি নিয়ে আসে।” (সূরা আন-নূর:৫৯)
প্রত্যক্ষভাবে অনুমতি না চেয়ে এমন কোন সম্বোধন বা শব্দও যদি উচ্চারণ করে যার দ্বারা বুঝা যায় যে সে নিকটে আসতে চায় সেটাও অনুমতি চাওয়া বলে গণ্য হবে।প্রখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ(রা) বলেন, “তোমরা তোমাদের আম্মা ও বোনদের কাছে যাওয়ার সময়ও অনুমতি নিয়ে যাও।” (ইবনু কাসীর)।
আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদের (রা) স্ত্রী যায়নাবের (রা) বর্ণনা থেকে জানা যায় যে আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ(রা) তার ঘরে প্রবেশ করার সময়ও এমন কোন আওয়াজ করতেন যাতে বুঝা যেত যে তিনি আসছেন। হঠাৎ ঘরের মধ্যে ঢুকে যাওয়া তিনি পছন্দ করতেন না। (ইবনু জারীর)
১৮. বৃদ্ধারা যদি সাজ–সৌন্দর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্য ছাড়া তাদের চাদর নামিয়ে রাখেন এতে কোন দোষ নেই। তবে বৃদ্ধারাও যদি লজ্জাশীলতা অবলম্বন করেন সেটাই তাদের জন্য উত্তম।
আল্লাহ বলেন, “আর যেই সব বৃদ্ধা বিয়ের আশা রাখে না তারা যদি সাজ-সৌন্দর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্য ছাড়া নিজেদের চাদর নামিয়ে রাখে এতে কোন দোষ নেই। তবে তারা যদি লজ্জাশীলতা অবলম্বন করেন সেটাই তাদের জন্য উত্তম।”(আননূর-৬০)
“আলকাওয়া’য়েদু মিনা ন্নিসায়ে” অর্থ হচ্ছে “বসে পড়া মহিলারা।”অর্থাৎএমন বয়সে পৌঁছে যাওয়া মহিলাগণ যেই বয়সে তাদের সন্তান জন্ম দেবার যোগ্যতা থাকে না এবং তাদেরকে দেখে পুরুষদের মধ্যেও কোন যৌন বাসনার সৃষ্টি হয় না।
এমন বৃদ্ধাদেরও সাজ -সৌন্দর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নিজেদের চাদর নামিয়ে রাখার অনুমতি নেই। তবে সাজ-সৌন্দর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্য না থাকলে তাদের চাদর নামিয়ে রাখার অনুমতি আছে।
পর্দার বিধান
পর্দার বিধান সমাজ জীবনের পবিত্রতা নিশ্চিত করার জন্য বিজ্ঞান সম্মত বিধান। এই বিধানের তাৎপর্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে আবেগ মুক্ত মন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করা প্রয়োজন।
পর্দার বিধানের স্বরূপ নির্ণয়ে সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ) প্রয়াস প্রশংসনীয়। তাঁর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যাঁদেরকে উপলব্ধি করে আল হিজাবের বিধান নাযিল করা হয়েছিল সেই উম্মুল মুমিনীনদের আমলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পর্দার বিধান ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন,
ক) সৌন্দর্য প্রকাশের সীমারেখা
“দৃষ্টি সংযমের নির্দেশাবলী নারী ও পুরুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। আবার কতক নির্দেশ নারীদের জন্য নির্দিষ্ট । তার মধ্যে প্রথম নির্দেশ এই যে ,একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে আপন সৌন্দর্য প্রদর্শন করা চলবে না। এই নিদের্শের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে চিন্তা করবার পূর্বে ঐ সকল নির্দেশ স্মরণ করা দরকার । মুখমন্ডল ছাড়া নারীর সারা শরীর “সতর” যা পিতা,চাচা, ভাই এবং পুত্রের নিকটও উন্মুক্ত রাখা জায়েয নয়। এটা সামনে রেখে সৌন্দর্য প্রকাশের সীমারেখা আলোচনা করা যাক।
১. নারীকে তার সৌন্দর্য স্বামী, পিতা, শ্বশুর, সৎপুত্র, ভাই, ভাইপো, এবং বোনের ছেলের সম্মুখে প্রকাশ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
২. তাকে আপন গোলামের সম্মুখে (অন্য কারো গোলামের সম্মুখে নয়) সৌন্দর্য প্রদর্শনের অনুমতি দেয়া হয়েছে।
৩. নারী এমন লোকের সামনেও সৌন্দর্য-শোভা সহকারে আসতে পারে যে তার অনুগত ও অধীন এবং নারীদের প্রতি তার কোন আগ্রহ-আকাঙ্খা নেই ।
৪. যে সকল বালকের মধ্যে এখনো যৌন অনুভূতির সঞ্চার হয়নি তাদের সম্মুখেও নারী সৌন্দর্য প্রদর্শন করতে পারে।
আল কুরআনে উল্লেখ রয়েছে “(অর্থাৎ) এমন বালক যারা গোপন কথা সম্পর্কে পরিজ্ঞাত হয়নি।
৫. সকল সময় মেলামেশা করে এমন মেয়েদের সামনে নারীর সৌন্দর্যশোভা প্রদর্শন জায়েয আছে। আলকুরআনে ‘সাধারণ নারীগণ’ শব্দের পরিবর্তে ‘ আপন নারীগণ’ ব্যবহার করা হয়েছে। এর দ্বারা ‘সম্ভ্রান্ত মহিলাগণ’ অথবা ‘আপন মহিলা আত্মীয়-স্বজন অথবা ‘আপন শ্রেণীর মহিলাগণ’কেই বুঝানো হয়েছে। অজ্ঞ-মূর্খ নারী’ এমন নারী যাদের চালচলন সন্দেহযুক্ত অথবা যাদের চরিত্রে কলংক ও লাম্পট্যের ছাপ আছে এই সকল নারীর সম্মুখে আলোচ্য নারীর সৌন্দর্য প্রদর্শনের অনুমতি নেই। কারণ এরাও অনাচার অমঙ্গলের কারণ হতে পারে। মুসলিমগণ সিরিয়া যাওয়ার পর মুসলিম মহিলাগণ ইয়াহুদি-খৃস্টাণ মহিলাদের সাথে মেলামেশা আরম্ভ করলে হযরত উমার (রা) সিরিয়ার গভর্নর আবু উবায়দাহ ইবনুল জাররাহকে (রা) লিখে জানালেন যাতে মুসলিম মহিলাগণকে আহলে কিতাব নারীদের সাথে হাম্মামে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়। (তাফসীরে ইবনে জারীর) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) ব্যাখ্যা করেন যে, মুসলিম মহিলাগণ কাফির এবং জিম্মী নারীদের সামনে ততটুকু প্রকাশ করতে পারে যতটুকু অপরিচিত পুরুষদের সামনে প্রকাশ করতে পারে। (তাফসীরে কবীর)
কোন ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা এসবের উদ্দেশ্য ছিলো না। বরং যে সকল নারীর স্বভাব চরিত্র ও তাহযীব-তামাদ্দুন জানা ছিলো না অথবা ইসলামের দৃষ্টিতে আপত্তিকর বলে জানা ছিলো-এই ধরনের নারীর প্রভাব থেকে মুসলিম নারীদেরকে রক্ষা করা ছিলো এসবের উদ্দেশ্য। আবার অমুসলিম নারীদের মধ্যে যারা সম্ভ্রান্ত ও লজ্জাশীল তারা আল-কুরআনের নির্দেশিত আপন মহিলাদের মধ্যে শামিল।
এই সকল সীমারেখা সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করলে দু’টো বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে।
১. যে সৌন্দর্য প্রকাশের অনুমতি এই সীমাবদ্ধ গণ্ডীর মধ্যে দেয়া হয়েছে তা ‘সতর-আওরতের’ আওতা বর্হির্ভুত অংগাদির। অর্থাৎ অলংকারাদি পরিধান করা,সুন্দর বেশভূষায় সজ্জিত হওয়া,সুরমা ও সুগন্ধি ব্যবহার করা এবং অন্যান্য বেশভূষা যা নারীগণ নারীসুলভ চাহিদা অনুযায়ী আপন গৃহে পড়তে অভ্যস্ত হয়।
২. এ ধরনের বেশভূষা প্রদর্শনের অনুমতি ঐ সকল পুরুষদের সম্মুখে দেয়া হয়েছে যাদেরকে নারীদের জন্য চিরদিনের জন্য হারাম করে দেয়া হয়েছে অথবা ঐ সকল লোকের সম্মুখে যাদের মধ্যে যৌন বাসনা নেই অথবা ঐ লোকের সম্মুখে যারা কোন অনাচার অমঙ্গলের কারণ হবে না।
নারীদের বেলায় ‘আপন মহিলাগণ’ শর্ত আরোপ করা হয়েছে। অধীনদের জন্য‘যৌন বাসনাহীন’ শর্ত আরোপ করা হয়েছে । বালকদের জন্য ‘নারীদের গোপন বিষয় সম্পর্কে অপরিজ্ঞাত’ শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এ থেকে জানতে পারা গেল যে ,শরীয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্য হচ্ছে নারীর সৌন্দর্য এমন গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাতে তার সৌন্দর্য ও বেশভূষা দ্বারা কোন প্রকার অবৈধ উত্তেজনা সৃষ্টি এবং যৌন উচ্ছৃংখলতার আশংকা হতে না পারে।
এই গণ্ডির বাইরে যত পুরুষ আছে তাদের সম্পর্কে এই আদেশ করা হয়েছে যে ,তাদের সম্মুখে সৌন্দর্য ও বেশভূষা প্রদর্শন করা চলবে না। উপরন্তু পথ চলার সময় এমন ভাবে পদক্ষেপ করা চলবে না যাতে গোপন সৌন্দর্য ও বেশভূষা পদধ্বনি দ্বারা প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং পুরুষের দৃষ্টি উক্ত নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই আদেশ দ্বারা যে সৌন্দর্য পর পুরুষ থেকে গোপন করতে বলা হয়েছে তা ঠিক তাই যা উপরে উল্লেখিত সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে প্রকাশ করবার অনুমতি দেয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য অতি স্পষ্ট । মহিলারা যদি বেশভূষা করে এমন লোকের সম্মুখে আসে যারা যৌন লালসা রাখে এবং মাহরাম না হওয়ার কারনে যাদের মনের যৌন লালসা পবিত্র নিষ্পাপ ভাবধারায় পরিবর্তিত হয়নি তাহলে অবশ্যম্ভাবীরুপে এর প্রতিক্রিয়া মানব সুলভ চাহিদা অনুযায়ী হবে। এটা কেউ বলে না যে , এরূপ সৌন্দর্য প্রকাশের প্রতিটি নারী চরিত্রহীন হবে এবং প্রতিটি পুরুষ কার্যত: পাপাচারী হয়ে পড়বে । কিন্তু এটাও কেউ অস্বীকার করতে পারেনা যে,সুন্দর বেশভূষা সহকারে নারীদের প্রকাশ্য চলাফেরা এবং জনসমাবেশে অংশগ্রহণ করার ফলে অসংখ্য গোপন ও প্রকাশ্য , মানসিক ও বৈষয়িক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে । আজকের ইউরোপ ও আমেরিকার নারীসমাজ নিজেদের ও স্বামীর উপার্জিত অর্থের অধিকাংশ বেশভূষায় ব্যয় করছে। তাদের এই ব্যয়ভার এত বেড়ে যাচ্ছে যে, তা বহন করার আর্থিক সংগতিও তাদের নেই। যে সকল যৌন লালসাপূর্ণ দৃষ্টি বাজারে,অফিসে ও জনসমাবেশে যোগদানকারী নারীদেরকে খোশ আমদেদ জানায় তাই কি এই উন্মাদনা সৃষ্টি করেনি? আবার চিন্তা করে দেখুন, নারীদের মাঝে সাজসজ্জার এই প্রবল আকাঙক্ষা সৃষ্টি হওয়ার ও তা বৃদ্ধি পেতে থাকার কারণ কি? এর কারণ কি এটাই নয় যে , তারা পুরুষের প্রশংসা লাভ করতে ও তাদের চোখে পছন্দনীয় হতে চায়? তা কি একেবারে নিষ্পাপ আকাংক্ষা ? এর মাঝে কি যৌন বাসনা লুকায়িত নেই যা নিজের স্বাভাবিক গণ্ডীর বাইরে বিস্তার লাভ করতে চায় এবং যার দাবী পূরণের জন্য অপর প্রান্তেও অনুরূপ বাসনা রয়েছে? আপনি যদি এ সত্যকে অস্বীকার করেন তাহলে আগামীকাল হয়তো আপনি এটা দাবী করতে দ্বিধা করবেন না যে, যে আগ্নেœয়গিরিতে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে তার ভেতরের লাভা বাহিরে ছুটে আসতে উন্মুখ নয়। কাজ করার স্বাধীনতা আপনার আছে । যা আপনার ইচ্ছা তা করুন। কিন্তু সত্যকে অস্বীকার করবেন না। এ সত্য এখন আর গোপনও নেই। দিনের আলোর মতই এর ফল প্রকাশ হয়ে পড়েছে।এই ফল আপনি জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে গ্রহণ করছেন। কিন্তু যেখান থেকে এর প্রকাশ সুচিত হয় ইসলাম সেখান থেকেই এর প্রকাশ বন্ধ করে দিতে চায়। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে সৌন্দর্য প্রকাশের বাহ্যতঃ নিষ্পাপ সূচনার ওপর নিবদ্ধ নয় বরং যে ভয়ানক পরিণাম কিয়ামতের অন্ধকারের মত সমগ্র সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে তার ওপরই নিবদ্ধ।
“পর পুরুষের সম্মুখে সাজসজ্জা সহকারে বিচরণকারী নারী আলোবিহীন কিয়ামতের অন্ধকারের মত।”(জামিউত তিরমিযী)
আলকুরআনে যে পর পুরুষের সম্মুখে সৌন্দর্য প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেখানে একটি ব্যতিক্রমও আছে। যথা,‘ইল্লা মা জাহারা মিনহা’। এর অর্থ হচ্ছে যে সৌন্দর্য বা বেশভূষা আপনা আপনি প্রকাশ হয়ে পড়ে, তাতে কোন দোষ নেই।
লোকেরা এই ব্যতিক্রম থেকে কিছু সুবিধা লাভ করবার চেষ্টা করছে।কিন্তু আসলে এই শব্দগুলো থেকে সুবিধা লাভের কোন অবকাশ নেই। শরীয়াত প্রণেতা এই কথা বলেন যে,স্বেচ্ছায় অপরের সম্মুখে সৌন্দর্য প্রকাশ করো না । কিন্তু যে বেশভূষা আপনা আপনি প্রকাশ হয়ে পড়ে অথবা প্রকাশ হতে বাধ্য তার জন্য কেউ দায়ী হবে না । এর অর্থ অত্যন্ত পরিষ্কার। তোমার নিয়ত যেন সৌন্দর্য ও বেশভূষা প্রকাশের না হয়। তোমার মনে এই ইচ্ছা ও প্রেরণা কিছুতেই হওয়া উচিত নয় যে , নিজের সাজসজ্জা অপরকে দেখাবে কিংবা কিছু না হলেও অন্তত অলংকারাদির লুপ্ত ঝংকার শুনিয়ে তোমার প্রতি অপরের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে । তোমাকে তো আপন সৌন্দর্য-শোভা গোপন করবার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। এরপর যদি কোন কিছু অনিচ্ছা সত্তে¡ও প্রকাশ হয়ে পড়ে এর জন্য আল্লাহ তোমাকে দায়ী করবেন না । তুমি যে বস্ত্র দ্বারা তোমার সৌন্দর্য ঢেকে রাখবে তা তো প্রকাশ পাবেই। তোমার দেহের গঠন ও উচ্চতা, শারীরিক সৌষ্ঠব ও আকার আকৃতি তো এতে ধরা যাবে। কাজ-কর্মের জন্য আবশ্যক মতো তোমার হাত দুটো ও মুখমণ্ডলের কিয়দংশ তো উন্মুক্ত করতেই হবে। এরূপ হলে কোন দোষ নেই। তোমার ইচ্ছা তা প্রকাশ করা নয়, বাধ্য হয়েই তুমি তা করছো । এতে যদি কোন অসৎ ব্যক্তি আনন্দ-স্বাদ উপভোগ করে তো করুক। সে তার অসৎ অভিলাসের শান্তি ভোগ করবে। তামাদ্দুন ও নৈতিকতা যতখানি দায়িত্ব তোমার ওপর অর্পণ করেছিলো তুমি তা সাধ্যানুযায়ী পালন করেছো। উপরি উক্ত আয়াতের মর্ম এটাই।
তাফসীরকারগণের মধ্যে এই আয়াতের মর্ম নিয়ে যত প্রকার মতভেদ আছে তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করলে জানতে পারা যাবে যে, যাবতীয় মত-পার্থক্য সত্তে¡ও আয়াতের মর্ম তাই দাঁড়াবে যা উপরে বলা হল। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, ইবরাহিম নাখয়ী এবং হাসান বসরীর মতে, প্রকাশ্য সৌন্দর্যের অর্থ সকল বস্ত্রাদি যার মধ্যে আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য ঢেকে রাখা যায়; যেমন বোরকা, চাদর ইত্যাদি।
আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ আ’তা ইবনে উমার, আনাস, জাহহাক, সাঈদ, ইবনে যুবাইর, আওযায়ী এবং হানাফী মতালম্বী ইমামদের মতে এর অর্থ মুখমন্ডল ও হস্তদ্বয় এবং এতে ব্যবহৃত সৌন্দর্য উপাদান সমূহ যেমন হাতের মেহেদি, আংটি, চোখের সুরমা প্রভৃতি । সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েবের মতে ব্যতিক্রম শুধু মুখমন্ডল এবং এক বর্ণনাতে হাসান বসরীও এই মত সমর্থন করেন। আয়িশার (রা) মতে প্রকাশ্য সৌন্দর্যের অর্থ হস্তদ্বয়,হাতের চুরি, আংটি, কংকন ইত্যাদি। তিনিও মুখমন্ডল ঢেকে রাখার পক্ষে।
মিসওয়ার ইবনে মাখরামা এবং কাতাদাহ অলংকারাদিসহ হাত খুলবার অনুমতি দেন এবং তার উক্তিতে মনে হয় যে, তিনি সমগ্র মুখমন্ডলের পরিবর্তে শুধু দুচোখ খুলে রাখা জায়েজ রাখেন। (ইবনে জারীর ও আহকামুল কুরআন)।
এই সকল মতভেদেও উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা করে দেখুন। এই সকল মুফাসসির “ইল্লা মা জাহারা মিনহা” সম্পর্কে এটাই বলেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা এমন সৌন্দর্য প্রকাশের অনুমতি দেন যা আবশ্যিকভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে অথবা যা প্রকাশ করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। হাতের প্রদর্শনী অথবা একে কারো দৃষ্টির বিষয়বস্তু বানানো এদের কারো উদ্দেশ্য নয়। প্রত্যেকে আপন আপন বোধশক্তি অনুযায়ী নারীদের প্রয়োজনকে সামনে রেখে এটা বুঝবার চেষ্টা করেছেন যে ,প্রয়োজন হলে কোন বিষয়ে কতখানি পর্দার বাইরে যাওয়া যায় অথবা কোন অঙ্গ আবশ্যিকভাবে উন্মুক্ত করা যায় কিংবা স্বভাবতই উন্মুক্ত হয়। আমরা বলি যে “ইল্লা মা যাহরা মিনহা”কে এর কোন একটিতেও সীমাবদ্ধ রাখবেন না। যে মুমিন নারী আল্লাহ ও তার রাসূলের (সা) নির্দেশাবলীর অনুগত থাকতে চায় এবং অনাচার অমঙ্গলে লিপ্ত হওয়া যার ইচ্ছা নয় সে নিজেই নিজের অবস্থা ও প্রয়োজন অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে, সে মুখমন্ডল ও হস্তদ্বয় উন্মুক্ত করবে কি করবে না, করতে চাইলে কোন সময়ে করবে, কতটুকু উন্মুক্ত ও কতটুকু আবৃত রাখবে। এই ব্যাপারে ও শরীয়ত প্রণেতা কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ দেননি। অবস্থার বিভিন্নতা ও প্রয়োজন দেখে নির্দেশ নির্ধারণ করতে হবে। যে নারী আপন প্রয়োজনে বাইরে যেতে ও কাজকর্ম করতে বাধ্য তার হাত এবং কখনো মুখমন্ডল খোলার প্রয়োজন হবে। এইরূপ নারীর জন্য প্রয়োজন অনুসারে অনুমতি রয়েছে। কিন্তু যে নারীর অবস্থা এইরূপ নয় তার বিনা কারণে স্বেচ্ছায় মুখমন্ডল ও হস্তদ্বয় অনাবৃত করা দুরস্ত নয়।
অতএব শরীয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্য এই যে, যদি নিজের সৌন্দর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে কোন অংগ অংশ অনাবৃত করা হয় তাতে পাপ হবে অনি”্ছায় আপনা আপনি কিছু প্রকাশিত হয়ে পড়লে তাতে কোন পাপ হবে না। প্রকৃত প্রয়োজন যদি অনাবৃত করতে বাধ্য করে তাহলে তা জায়েজ হবে এখন প্রশ্ন এই যে, অবস্থার বিভিন্নতা হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে শুধু মুখমন্ডল সম্পর্কে কি নির্দেশ রয়েছে? শরীয়ত প্রণেতা একে পছন্দ করেন না অপছন্দ করেন? শুধুমাত্র প্রয়োজনের সময় একে অনাবৃত করা যায়, না অপরের দৃষ্টি থেকে একে লুকিয়ে রাখার বস্তুই নয়?সূরা আহযাবের আয়াতগুলোতে এসব প্রশ্নের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। “হে নবী, তোমার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ এবং মুসলিম মহিলাগণকে বলে দাও তারা যেন চাদর দ্বারা নিজেদের ঘোমটা টেনে দেয়। এই ব্যবস্থার দ্বারা আশা করা যায় যে, তাদেরকে চিনতে পারা যাবে এবং তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না।”(আল আহযাব:৫৯)
বিশেষ করে মুখমন্ডল আবৃত করার নির্দেশ নিয়েই এই আয়াত নাযিল হয়েছে। “জিলবাব” শব্দের বহুবচন “জালাবীব।” এর অর্থ চাদর। ‘এদনা’ শব্দের অর্থ লটকান। “ইউদনিনা আলাইহিননা মিন আলাবিবে হিন্না”অর্থ নিজেদের ওপর চাদরের খানিক অংশ যেন লটকিয়ে দেয়। ঘোমটা দেয়ার অর্থও এটাই।কিন্তু এই আয়াতের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধারণভাবে পরিচিত ঘোমটা নয়। এর উদ্দেশ্য মুখমন্ডল আবৃত করণ । তা ঘোমটার দ্বারা হোক, চাদর অথবা অন্য যে কোন উপায়ে হোক । এর উপকারিতা এই বর্ননা করা হয়েছে যে, যখন মুসলিম নারী এভাবে আবৃত অবস্থায় ঘরের বাইরে যাবে ,তখন লোকেরা বুঝতে পারবে যে, এ এক সম্ভ্রান্ত মহিলা-নির্লজ্জ ও শ্লীলতা বর্জিত মহিলা নয়। এ কারনে কেউ তার শ্লীলতার প্রতিবন্ধক হবে না।
আল কুরআনের সকল মুফাসসির এই আয়াতের এই মর্মই ব্যক্ত করেছেন।
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) এই আয়াতের তাফসীরে বলেন, আল্লাহ তা’আলা মুসলিম নারীদেরকে আদেশ করেছেন যে, তারা যখন প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাবে তখন যেন তারা মাথার ওপর থেকে চাদরের অংশ ঝুলিয়ে মুখমন্ডল ঢেকে নেয়।”(তাফসীরে ইবনে জারীর)
ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে শিরীন হযরত উবাইদা ইবনে সুফিয়ান ইবনে আলহারেস আলহাযরামীর নিকট জানতে চাইলেন, এই নির্দেশের ওপর কিভাবে আমল করতে হবে। এর উত্তরে তিনি নিজের ওপর চাদর ঝুলিয়ে দেখিয়ে দিলেন। কপাল, নাক ও একটি চোখ ঢেকে ফেললেন। শুধু একটি চোখ অনাবৃত রাখলেন। (তাফসীরে ইবনে জারির)
আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী এই আয়াতের তাফসীরে লিখেন, ‘হে নবী, আপনার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ ও মুসলিম মহিলাগণ কে বলে দিন, যখন কোন প্রয়োজনে আপন ঘর থেকে বাইরে যায় তখন যেন ক্রীতদাসীদের পোশাক না পরে- যে পোশাকে মাথা ও মুখমন্ডল অনাবৃত থাকে এবং তারা যেন নিজেদের ওপরে চাদরের ঘোমটা টানিয়ে দেয় যাতে ফাসিক লোকেরা তাদের শীতল অন্তরায় না হয় এবং জানতে পারে এরা সম্ভ্রান্ত মহিলা।’ (তাফসীরে ইবনে জারীর)
আল্লামা আবু বকর জাসসাস বলেন, “এই আয়াতের দ্বারা এই কথা প্রমাণিত হয় যে, যুবতী নারীকে পরপুরুষ হতে তার মুখমন্ডল আবৃত রাখার আদেশ করা হয়েছে এবং ঘর থেকে বাইরে যাবার সময় পর্দা পালন ও সম্ভ্রমশীলতা প্রদর্শন করা উচিত যাতে অসৎ অভিপ্রায় পোষণকারী তার প্রতি প্রলুব্ধ হতে না পারে।” (আহকামুল কুরআন)
আল্লামা নিশাপুরী তাঁর ‘তাফসীরে গারায়েবুল কুরআনে’ লিখেন, “ইসলামের প্রাথমিক যুগে মেয়েরা জাহিলিয়াত যুগের মতো কামিজ ও দোপাট্টা পরে বাইরে যেতো । সম্ভ্রান্ত মহিলাদের পোশাকও নিম্নশ্রেণীর মেয়েদের পোশাক থেকে পৃথক ছিলোনা। অতঃপর আদেশ হলো যে, তারা যেন চাদর টেনে তাদের মুখমন্ডল ঢেকে ফেলে যাতে লোকেরা মনে করতে পারে যে, এরা সম্ভ্রান্ত মহিলা, অশ্লীলতা বর্জিত মহিলা।” ইমাম রাজী লিখেন, “জাহিলিয়াত যুগে সম্ভ্রান্ত মহিলাগণ এবং কৃতদাসীগণ বেপর্দা চলাফেরা করতো এবং অসৎ লোক তাদের পিছু নিতো। আল্লাহ তা’আলা সম্ভ্রান্ত নারীদের প্রতি আদেশ করলেন তারা যেন চাদর দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করে। ‘যালিকা আদনা আঁইউরাফনা ফালা ইউযাইনা”-আয়াতাংশের দু’প্রকার মর্ম হতে পারে। এক. এই পোশাক থেকে বুঝা যাবে যে, এরা সম্ভান্ত মহিলা এবং এদের পিছু নেয়া হবে না। দুই .এর দ্বারা বুঝা যাবে যে,এরা চরিত্রহীনা নয়। কারণ যে নারী তার মুখমন্ডল ঢেকে রাখে তার কাছ থেকে কেউ এ আশা পোষণ করতে পারে না যে, সে আওরত (শরীরের যে অংশ স্বামী-স্ত্রী ছাড়া সকলের নিকট আবৃত রাখতে হয়) অনাবৃত করতে রাজী হবে। এই পোশাক এটাই প্রমাণ করবে যে,সে একজন পর্দানশীন নারী এবং তার দ্বারা কোন অসৎ কাজের আশা করা বৃথা।”(তাফসীরে কবীর)
কাযী বায়জাবী লিখেন, “ইউদনীনা আলাইহিন্না মিন জালাবীবে হিন্না’-র অর্থ এই যে, যখন তারা আপন প্রয়োজনে বাইরে যাবে তখন চাদর দ্বারা একাংশ ও মুখমন্ডল ঢেকে নেবে। এখানে ‘মিন’ শব্দটি ‘তাব’য়ীদ’- এর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।অর্থাৎ চাদরের একাংশ দিয়ে মুখমন্ডল আবৃত করতে হবে একাংশ শরীরের ওপর জড়িয়ে দিতে হবে। ‘যালিকা আদনা আইউরাফনা’ দ্বারা সম্ভ্রান্ত নারী।এবং ক্রীতদাসী ও গায়িকাদের মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। “ফালা ইউযাইনা’’ দ্বারা বুঝানো হয়েছে’ সন্দেহভাজন লোক তাদের শ্লীলতাহানির দুঃসাহস করবে না।”(তাফসীরে বায়জাবী)
এ সকল উক্তি থেকে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কিরামের(রাঃ) পবিত্র যুগ থেকে শুরু করে অষ্টম শতব্দী পর্যন্ত প্রত্যেক যুগে উক্ত আয়াতের একই মর্ম করা হয়েছে। হাদীসগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর নবী করীমের (সা) যুগে সাধারণভাবে মুসলিম নারীগণ মুখমন্ডলের ওপর আবরণ দেয়া শুরু করেন এবং অনাবৃত মুখমন্ডল নিয়ে চলাফেরার প্রচলন বন্ধ হয়ে যায়।
সুনানু আবী দাউদ, জামিউত তিরমিযী, মুয়াত্তা ইমাম মালিক ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থগুলিতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) ইহরাম অবস্থায় মহিলাদের মুখে আবরণ এবং হাতে দস্তানা পরিধান করা নিষেধ করে দিয়েছেন । এতে প্রমাণিত হয় যে সেই পবিত্র যুগেই মুখমন্ডল আবৃত করার জন্য আবরণ এবং হস্তদ্বয় ঢাকবার জন্য দস্তানা ব্যবহারের প্রচলন ছিলো। শুধু ইহরামের অবস্থায় তা ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছিলো। কিন্তু হজ্জের সময় নারীর মুখমন্ডল জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর করা এর উদ্দেশ্য ছিলো না। এর উদ্দেশ্য ছিলো, ইহরামের দীনবেশে মুখের আবরণ যেন নারীদের পোশাকের কোন অংশবিশেষ না হতে পারে যা অন্য সময়ে সাধারণভাবে হয়ে থাকে।
অন্যান্য হাদীসে রয়েছে যে, ইহরাম অবস্থায়ও নবীর (সা) স্ত্রীগণ ও অন্যান্য মুসলিম মহিলাগণ আবরণহীন মুখমন্ডল পর-পুরুষের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখতেন।হযরত আয়িশা (রা)বলেন, “যানবাহন আমাদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলো এবং আমরা রাসূলুল্লাহর(সা) সংগে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম।যখন লোক আমাদের সম্মুখে আসতো, আমরা আমাদের চাদর মাথার ওপর থেকে মুখমন্ডলের ওপর টেনে দিতাম।তারা চলে গেলে আবার মুখমন্ডল খুলে দিতাম।” (সুনানু আবী দাউদ)
ফাতিমা বিনতে মানযার বলেন, “আমরা ইহরাম অবস্থায় কাপড় দিয়ে মুখমন্ডল ঢেকে রাখতাম। আমাদের সাথে আসমা বিনতে আবু বকরও ছিলেন।
“কিতাবুল হজ্জ্বে হযরত আয়িশার (রা) এই উক্তি উদ্বৃত রয়েছে: “নারীগণ যেন ইহরাম অবস্থায় নিজেদের চাদর মাথা থেকে মুখমন্ডলের ওপর ঝুলিয়ে দেয়।”
“আলকুরআনের সংশ্লিষ্ট শব্দাবলী ও জনসাধারণ্যে তার স্বীকৃতি, সর্বসম্মত তাফসীর এবং রাসূলুল্লাহর (সা) যুগে তার বাস্তবায়নের দিকে যে ব্যক্তি লক্ষ্য করবে তার পক্ষে এ সত্যকে অস্বীকার করা সম্ভব হবে না যে, ইসলামী শরীয়তে পর-পুরুষের সামনে নারীদের মুখমন্ডল ঢেকে রাখার নির্দেশ রয়েছে এবং স্বয়ং রাসূলুল্লাহর (সা) যুগেই এ নির্দেশ প্রতিপালিত হয়েছে। যে পবিত্র ব্যক্তিত্বের প্রতি আলকুরআন নাযিল হয়েছিলো তাঁর চোখের সামনেই মুসলিম মহিলাগণ একে বাহিরের পোশাকের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং সেকালেও এর নাম ছিলো ‘নিকাব’ বা আবরণ।”
“ইল্লামা যাহারা মিনহা” আয়াতাংশের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মত-পার্থক্য রয়েছে ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে। কেউ কেউ এই আয়াতাংশের চেহারা খোলা রাখার অনুমতি রয়েছে বলে মনে করেন। কিন্তু সুক্ষ্নদর্শী ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ) এই আয়াতাংশের যেই জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ পেশ করেছেন তা অসাধারণ। তিনি বলেন, “প্রকাশ হওয়া” এবং “প্রকাশ করার” মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আমরা দেখি আলকুরআন “প্রকাশ করা” থেকে বিরত রেখে “প্রকাশ হওয়া”-র ব্যাপারে অবকাশ দিচ্ছে। এই অবকাশকে “প্রকাশ করা” পর্যন্ত বিস্তৃত করা আল কুরআনের বিরোধী এবং এমন সব হাদীসেরও বিরোধী যেগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে নবীর (সা) যুগে আলহিজাবের নির্দেশ আসার পর মহিলারা (চক্ষু ছাড়া) চেহারা খুলে চলতেন না, আলহিজাবের হুকুমের মধ্যে চেহারার পর্দা ও ছিলো এবং ইহরাম ছাড়া অন্যান্য অবস্থায় নিকাবকে মহিলাদেরকে পোশাকের একটি অংশে পরিণত করা হয়েছিলো।”
[উৎস: এ কে এম নাজির আহমেদ রচিত“পর্দার আসল রূপ” গ্রন্থ ও তাঁর “মাওলানা মওদূদী” গ্রন্থের পর্দার বিধান অংশটি সংকলন করা হয়েছে]
Comments are closed.