নিশ্চয় আমি আল্লাহ্। আমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। অতএব শুধু আমারই বন্দেগী কর এবং আমার ইয়াদের জন্যে নামায কায়েম কর। ”(তাহা : ১৪)
ফারসী শব্দ নামায একটি সুপরিচিত শব্দ। কুরআনের পরিভাষায় ‘সালাতের’ স্থলে নামায ব্যবহৃত হয়। সালাত এর আভিধানিক অর্থ কারো দিকে মুখ করা, অগ্রসর হওয়া, তাঁর কাছেই চাওয়া এবং তাঁর একেবারে হওয়া। এবং সিজদা কর এবং আল্লাহর নিকটবর্তী হও। ”(আলাক : ১৯)
হাদীসে আছে :
“বান্দাহ ঐ সময়ে তার আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী হয়, যখন সে আমার সামনে সিজদায় থাকে। ”(মুসলিম)
“তোমাদের মধ্যে যখন কেউ নামাযে রত হয়, তখন সে আল্লাহর কাছে মুনাজাত করে। ”(বুখারী)
নামাযে আমরা কি পড়ি :
নামায মানুষকে আল্লাহর ইবাদাত, দাসত্ব ও আনুগত্য স্বীকার করে চলার জন্য প্রস্তুত করে সর্বোতভাবে। নামাযের দোআ ও সূরাগুলোতে আমরা যা বলি, তা যদি আমরা হৃদয়মন দিয়ে উপলব্ধি করি তবে তা আমাদের বিশ্বাস, মতবাদ,
চিন্তাচেতনায়, স্বভাব ও জীবনবোধে যে কি অবিস্মরণীয় পরিবর্তন আনতে পারে তা আমি বছর খানেক ধরে এত বেশি উপলব্ধি করেছি যে আল্লাহর দ্বীনের পথে পথচলার যাত্রীদের এই উপলব্ধি দ্বারা উপকৃত করতে ব্যাকুলভাবে লিখছি।
আমি নামায সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছিলাম মুহতারাম মাওলানা মওদূদীর ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা (নামাজের হাকীকত অংশ) এবং অনুপ্রাণিত হয়েছি। এছাড়াও আমি কিছু বই থেকে জ্ঞান অর্জন করেছিলাম এবং অনুপ্রাণিত হয়েছি যা পরবর্তীতে রেফারেন্স হিসেবে উল্লেখ করবো ইনশায়াল্লাহ।
একটু আগে থেকেই আসি। আযান যে এক অবিস্মরণীয় আহবানের বার্তা দৈনিক পাঁচবার যখন আমাদের নামাজে আযান দিয়ে ডাকা হয় কী বলা হয় তখন ?
‘আল্লাহ সবচেয়ে বড়, আল্লাহ সকলের বড়। ’
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ভিন্ন আর কেউ মাবুদ নেই। বন্দেগীর যোগ্য আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নেই।
‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। ’
‘নামাজের জন্য আস। ’
‘যে কাজে কল্যাণ ও মঙ্গল সেই কাজের দিকে আস। ’
‘আল্লাহ সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে বড়। ’
‘আল্লাহ ভিন্ন কোন মাবুদ নেই। ’
এ ডাক কত বড় শক্তিশালী ডাক ! এ ডাক প্রত্যেক দিন পাঁচবার আমাদেরকে এ কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, পৃথিবীতে যতবড় খোদায়ীর দাবীদার দেখা যাচ্ছে তারা সবাই মিথ্যাবাদী, আকাশ ও পৃথিবীতে মাত্র একজনই খোদায়ী ও প্রভুত্বের অধিকারী এবং কেবল তিনি ইবাদাতের যোগ্য। সুতরাং আমরা সকলে মিলে তো তারই ইবাদাত করবো। তাঁর ইবাদাতেই আমাদের সকলের জন্য ইহকালের ও পরকালে প্রকৃত কল্যাণ নিহিত। ”
এ মর্মস্পর্শী আওয়াজ শুনে কে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকতে পারে ? এ ডাক শুনেই আমরা উঠে পড়ি এবং সর্বপ্রথমেই
চিন্তা করে দেখি আমি কি পবিত্র না অপবিত্র? অথবা আমার জামা কাপড় পবিত্র কিনা ? উভয় জাহানের বাদশাহের দরবারে হাজিরা দেবার বিষয়টি পৃথিবীর সকল বিষয় হতে সম্পূর্ণরুপে স্বতন্ত্র| অনন্য।
ওজু করার পর আমরা যে দোয়া পড়ি-
“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এক ও অদ্বিতীয় লা-শরীক আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বুদ নেই। এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর বান্দাহ এবং রাসূল। হে আল্লাহ, তুমি আমাকে তওবাকারীদের অন্তর্ভূক্ত কর এবং আমাকে পবিত্রতা অবলম্বনকারী বানাও। ”
জায়নামাজে দাঁড়িয়েই একনিষ্ঠ অনুভূতির সাথে আমরা নিম্নের দোয়া পড়ি-
আমি পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে আমার মুখ সেই সত্তার দিকে ফিরিয়ে নিয়েছি যিনি আসমান ও যমীন পয়দা করেছেন এবং আমি তাদের মধ্যে নই যারা তাঁর সাথে অন্যকে শরীক করে। বস্তুত আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও মৃত্যু একমাত্র আল্লাহরই জন্যে যিনি সমগ্র বিশ্বজগতের মালিক প্রভু। তাঁর কোন শরীক নেই, আমার উপরে তাঁরই হুকুম হয়েছে এবং অনুগতদের মধ্যে আমিই সকলের প্রথম অনুগত। (আল-আনয়াম)
দৃষ্টি সিজদার স্থানের উপর নিবদ্ধ রেখে বলি-
আল্লাহু আকবর আল্লাহ মহান।
তারপর নিম্নের দোয়া বা সানা পড়ছি-
তুমি পাক ও পবিত্র, হে আল্লাহ ! তুমিই প্রশংসার উপযুক্ত। তুমি বরকতদানকারী এবং মহান। তোমার নাম ও মর্যাদা বহু উচ্চে। তুমি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই।
এরপর বলছি-
“বিতাড়িত শয়তান থেকে পানাহ চাচ্ছি আল্লাহর কাছে। ”
“মেহেরবান দয়াময় আল্লাহর নামে শুরু করছি। ”
পড়ছি সুরা ফাতিহা-
-‘সারা জাহানের পালনকর্তা মহান আল্লাহর জন্যই সমগ্র ও সর্বপ্রকার তারীফ-প্রশংসা।
-তিনি অত্যন্ত দয়াময় ও মেহেরবান। -তিনি বিচার দিনের একমাত্র মালিক। সেদিন মানুষের যাবতীয় কর্মের বিচার করা হবে এবং প্রত্যেককে তাঁর কর্মের ফল ভোগ করতে হবে।
-হে মালিক ! আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি এবং কেবল তোমারই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।
-আমাদেরকে সহজ, সোজা, সঠিক পথ দেখাও।
-তাদের পথ, যারা তোমার অনুগ্রহ ও পুরস্কারপ্রাপ্ত।
-আর যারা অভিশপ্ত ও ভ্রান্ত পথে পরিচালিত নয়।
-হে আল্লাহ! আমাদের দোয়া কবুল কর, মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করো।
এক অমৃত আত্মসমর্পণ সূরা ফাতিহা। আমার সারা জাহানের পালন কর্তা মহান আল্লাহর জন্যই সব প্রশংসা। আমি সর্বদিক থেকে মুখফিরিয়ে শুধু তাঁরই দিকে অবতীর্ণ হলাম। বস্তুত: আমার সমর্পণ, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যুতো শুধু তাঁরই জন্য। শুধু তাঁর সন্তুষ্টির জন্যই আমার বেঁচে থাকা। সেই সাথে আমিতো শুধু সেই পথ চাই, যে পথ সবচেয়ে সঠিক, সবচেয়ে সুন্দর সিরাতুল মুস্তাকীম-সত্য, সঠিক। সেই সমুজ্জ্বল রাজপথের যাত্রীই তো আমি হতে চাই। সেই তাদের পথে যারা অনুগ্রহপ্রাপ্ত, পুরস্কারপ্রাপ্ত। সেই অভিশপ্ত, ভ্রান্ত পথের ধারকদের পথে নয়। আমরা তো শুধু সেই মহামহিম প্রভুর ইবাদত করি, যার কর্তৃত্ব সর্বব্যাপী, আসমান-জমীন সর্বত্র। যার প্রভুত্ব বরণ করে পৃথিবীর সকল শক্তির দাসত্ব থেকে আমি মুক্ত হয়েছি। আমার সাড়ে তিন হাত দেহ, মন ও মস্তিষ্কের সম্পূর্ণটা দিয়েই আমি শুধুই তাঁরই কাছে নত হয়েছি। তিনিই যে শুধু আমার মালিক। আর যে মালিক মর্যাদা দিয়েছেন যে আমি আশরাফুল মাখলুকাত। তাঁর সৃষ্ট সমগ্র সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ যে গর্বিত আমি শুধু তাঁরই ইবাদত করি। আর তাই তাঁর কাছেই সাহায্য চাই। তিনিই যে একমাত্র পরাক্রমশালী, একমাত্র ক্ষমতাবান রব। তিনি অত্যন্ত দয়াবান। তিনিই যে বিচার দিনের একমাত্র মালিক! সেই মহাফয়সালার দিন। যেদিন মানুষের যাবতীয় কর্মের বিচার হবে। আর প্রত্যেককে তাঁর কর্মের ফলভোগ করতে হবে। সারা জাহানের পালনকর্তা মহান আল্লাহর জন্যই আমার সমগ্র ও সর্বপ্রকার তারিফ-প্রশংসা।
আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে নামাজী হিসেবে কবুল করেছেন। মানুষ তো সৃষ্টিগতভাবেই কোন উদ্ধর্তন শক্তির কাছে মাথা নত করে। আলহামদুলিল্লাহ, আমি নত হয়েছি আমার প্রিয় প্রভুর কাছে। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি আছে
আমরা এই অমৃত সূরা ফাতিহাসহ নামাজের প্রথম থেকে এ পর্যন্ত দিন রাত ৫ বার নামাজে বারবার বলছি। বারবার!
মহাপ্রভু আমাদের সর্বোচ্চ সমর্পিত বান্দা হিসেবে কবুল করুন।সংক্ষিপ্ত কলেবরে নামাজ নিয়ে আজ এ অংশ পর্যন্ত লিখলাম। নামাজের বাকী আরকান আহকামে কিভাবে লুকিয়ে আছে আল্লাহতে পূর্ণাঙ্গ সমর্পণের জীবন্ত বার্তা- ইনশায়াল্লাহ আমরা আগামী সংখ্যায় আলোচনা করবো। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সাহায্য করুন। আপনাকে, আমাকে তাঁর কবুলকৃত দাস হিসেবে দয়া করে কবুল করুন। আমীন। সেটিই তো হবে আমাদের সর্বোচ্চ পাওয়া।
Comments are closed.