লাইলাতুল কদর

“হাজার মাসের চাইতে যে রাত মহামূল্যবান ‘শবে কদর’ সেই সে রাত শোন মুসলমান…”

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার রুবুবিয়্যাত অন্যতম নিদর্শন হলো মানবজাতির প্রতি অপার দয়াপরবশ অভিভাবকত্ব। আল্লাহর সৃষ্ট এই মানবজাতি যেন দিকভ্রান্ত ও অসহায় হয়ে না পড়ে, সেজন্যই আল্লাহ তাদের জন্য পাঠিয়েছেন সুস্পষ্ট হিদায়াত ও সঠিক দিক-নির্দেশনা, মহাগ্রন্থ আল কুরআন। সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ এই কিতাব আল্লাহর নিয়ামতগুলোর অন্যতম। তাইতো তিনি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছেন নিয়ামতপূর্ণ সময়েই, পবিত্র রমযান মাসে। আর এই পবিত্র কিতাবের মর্যাদা এত অধিক যে, এর মহিমায় মহিমানি¦ত হয়েছে একটি রজনী যা হাজার মাসের চেয়েও শ্রেষ্ঠ।
এই রজনীটি হচ্ছে কুরআন নাযিল হওয়ার রজনী; যাকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ‘লাইলাতুল কদর’ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন।

লাইলাতুল কদর
“নিশ্চয়ই আমরা এ কুরআনকে ‘লাইলাতুল কদরে নাযিল করেছি, তুমি জান, লাইলাতুল কদর কি? লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।” (সূরা আল কদর)
লাইলাতুল কদর হচ্ছে এমনি একটি রাত, যার অবস্থান রমজানের শেষ দশকের মধ্যে। ‘লাইলাতুন’ শব্দের অর্থ ‘রাত’। ‘কদর’ শব্দের অর্থ ‘নির্ধারণ করা, সম্মান করা, অতএব ‘লাইলাতুল কদর’ শব্দের অর্থ ‘নির্ধারণ করার রাত’, ‘সম্মানিত রাত’। লাইলাতুল কদরকে “লাইলাতুল মুবারাকান’ ও বলা হয়।

কুরআন ও হাদীসে লাইলাতুল কদর
“বরকতময় রাতে প্রত্যকটি মজবুত হুকুম সিদ্ধান্ত করা হয়।” (সূরা দুখান)
“কদরের রাতে ফেরেশতাগণ ও রুহ জিবরাইল (আ:) তাদের প্রভুর অনুমতিক্রমে প্রত্যেকটি হুকুম নিয়ে অবতীর্ণ হন।” (সূরা কদর)
এই দু’টি আয়াত থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, রাতে সৃষ্টির সাথে সম্পর্কিত সমস্ত বিষয়ে আল্লাহর হুকুম নিয়ে ফেরেশতাগণ দুনিয়ায় আসেন।
ইমাম নববী ও মোল্লা আলী ক্বারী বলেন, মুজতাহিদ আলেমগণ বলেছেন, এ রাতকে কদরের রাত (নির্ধারণ করার রাত) এজন্য বলা হয় যে, এক বছরের সমস্ত রিযিক, ভাগ্যসমূহ, যত মানুষের জন্ম হবে এবং যত মানুষের মৃত্যু হবে, তা এ রাতে ফেরেশতাদের দ্বারা লেখানো হয় (নির্ধারণ করা হয়)।
এছাড়া ভাগ্য নির্ধারণের আরেকটি অর্থ হচ্ছে, এই রাতে এমন একটি কিতাব (আল কুরআন) নাযিল হয়েছে, যা সমগ্র বিশ্ববাসীর ভাগ্য বদলে দিতে সক্ষম।
“লাইলাতুল কদর হচ্ছে হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।” (সূরা কদর)
“রমজান মাসে এমন একটি রাত আছে যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাত থেকে বঞ্চিত হবে, সে সমস্ত কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে, এর কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না।” (ইবনে মাজাহ, মিশকাত)
ইমাম যুহরী বলেন, “এ রাত অতীব উচ্চমান, মর্যাদা ও মাহাত্নের রাত্রি।”
শবে কদরের রাত মর্যাদা ও মূল্যের দিক থেকে, এ রাতে সংঘটিত ঘটনার দিক থেকে, এ রাতে বণ্টনকৃত এবং সংগৃহীত এমন ভাণ্ডারের দিক থেকে হাজার মাস তথা হাজার বছরের চেয়ে উত্তম।
হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, কদরের রাতে ফেরেশতার সংখ্যা পাথর কণার চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। ফলে শয়তানের রাজত্ব বাতিল হয়ে যায় এবং সে রাতে লোকেরা শয়তানের ক্ষতি থেকে নিরাপদ থাকে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, এ রাতের সৎ কাজ হাজার মাসের সৎ কাজের চেয়ে উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতে কিয়াম করবে তাকে সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়ার সুসংবাদ দেয়া হয়েছে, অন্যান্য রাতের মত এই রাতেও সেই নির্দিষ্ট সময়টি আছে, যখন দোয়া কবুল করে নেয়া হয়। এ রাতে ইহকাল ও পরকালের যে কোন কল্যাণ প্রার্থনা করা হয়, তা প্রদান করা হয়। এই মহান রহমত ও বরকতময় ফযীলতের ভিত্তিতেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই রাতকে হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতম রাত বলে আখ্যায়িত করেছেন।

লাইলাতুল কদরের তাৎপর্য
“নিশ্চয়ই আমি পবিত্র কুরআন মাজীদ অবতীর্ণ করেছি কল্যাণময় রজনীতে।” (সূরা দুখান)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেন, “হে মানবজাতি। তোমাদের নিকট তোমাদের প্রভুর পক্ষ থেকে পথ প্রদর্শক এসে গেছে। এটা সেই জিনিস যা অন্তরের সুস্থতা নিরাময় করে, যারা এটা গ্রহণ করবে তাদের জন্য পথপ্রদর্শক ও রহমত হিসেবে কাজ করবে। (হে নবী!) আপনি বলে দিন যে, আল্লাহ অত্যন্ত করুণা ও মেহেরবানী করে এ মহামূল্যবান জিনিস পাঠিয়েছেন, এ কারণেই লোকদের উৎসব করা উচিত। মানুষ যা কিছু সংগ্রহ করার কাজে ব্যস্ত সেসব কিছুর চেয়ে এটা শ্রেষ্ঠ।” (সূরা ইউনুস : ৫৭-৫৮)
কদরের রাত অন্য আট-দশটা সাধারণ রাতের মত নয়। সমগ্র মানবতা ও সমগ্র সৃষ্টিজগতের ভবিষ্যত সম্পৃক্ত হয়ে থাকে এ রাতে। কদরের রাত উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন করুণা, যাতে অল্প আয়াসে, অল্প বয়সে বান্দা অধিক পরিমাণ ইবাদতের মর্যাদা অর্জন করতে পারে। তবে, যদি কেউ চিন্তা করে যে, সারাজীবন আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে শুধু কদরের রাতে ইবাদত করলেই জান্নাত পেয়ে যাবে, তাহলে তা হবে চরম বোকামী। নবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামগণ সারাজীবন আল্লাহর আদেশ নিষেধ মানার সাথে সাথে কদরের রাতকেও যথাযথভাবে পালন করেছেন। এভাবে জীবন ধারণকারীই হবেন আল্লাহর পছন্দনীয় বান্দা।

লাইলাতুল কদরের ফযীলত
লাইলাতুল কদর একটি মহান রাত, যে রাত সম্পর্কে কুরআনে পূর্ণ একটি সূরা নাযিল হয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) স্পস্ট ও পরিস্কারভাবে কদরের রাতের ফযীলত বর্ণনা করেছেন।
ল বরকতময় রাতে সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেরেশতাগণ আসেন। (সূরা দুখান) অর্থাৎ ভাগ্য নির্ধারণের রাত এটি।
ল রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, “রমযান মাসে এমন একটি রাত আছে, যা হাজার মাস হতে উত্তম, যে ব্যক্তি সে রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে, সে সমগ্র কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবে, এর কল্যাণ থেকে একমাত্র হতভাগ্য লোক ছাড়া আর কেউ বঞ্চিত হয় না।” (ইবনে মাজাহ, মিশকাত, আত তারগীব)
ল বুখারী শরীফের হাদীসে এসেছে, রাসূল (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানসহ সওয়াবের নিয়তে ইবাদতের জন্য দাঁড়াবে, তার পেছনের সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।”
এ রাতে ইবাদতকারীকে ফেরেশতাগণ সালাম ও করমর্দন করে, তাদের দোয়ায় আমীন আমীন বলতে থাকে। রাসূল (সা.) বলেন, “যখন কদরের রাত উপস্থিত হয়, তখন আল্লাহ জিবরাঈল (আ.)-কে নির্দেশ দেন এবং তদনুযায়ী জিবরাঈল (আ.) বিরাট একদল ফেরেশতা নিয়ে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। আর তাদের সাথে সবুজ বর্ণের একটি নিশান থাকে। অতপর তারা নিশানটিকে কাবাঘরের মাঝখানে গেড়ে দেন। জিবরাঈল (আ.)-এর একশত ডানা (পাখা) আছে, সেগুলোর মধ্যে এমন দু’টি ডানা আছে যা তিনি কদরের রাত ছাড়া আর কোন রাতে খুলেন না। তিনি সে ডানা দু’টি এই রাতে বিস্তৃত করেন এবং তা পূর্বপ্রান্ত হতে পশ্চিমপ্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এরপর তিনি ফেরেশতাগণকে উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন। ফেরেশতাগণ ঐ সমস্ত লোককে সালাম করতে থাকে যারা দাঁড়িয়ে, বসে ইবাদত করে আর যারা নামায পড়ে এবং যারা আল্লাহকে স্মরণ করে, তারা তাদের সাথে করমর্দন করে এবং তাদের দোয়ায়ও শামিল হয়ে আমীন আমীন বলতে থাকে ফযর উদয় হওয়া পর্যন্ত। অতপর ফযর হলে জিবরাঈল (আ.) উচ্চস্বরে বলেন, হে ফেরেশতাগণ! চল, চল, তখন ফেরেশতাগণ বলে, হে জিবরাঈল। আহমাদ (সা.) এর মুমিন উম্মতের আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রয়োজনগুলো সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালা কি করলেন? উত্তরে তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা এ রাতে তাদের প্রতি সুদৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন এবং তাদের সম্পূর্ণরূপে ক্ষমা করেছেন।” (আত তারগীব ওয়াত তারহীত)
প্রকৃতপক্ষে লাইলাতুল কদর উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য একটি মহামূল্যবান নিয়ামত, পূর্ববর্তী আম্বিয়ায়ে কেরামগণের উম্মতগণ দীর্ঘ আয়ু পাওয়ার কারণে স্বভাবতই আল্লাহর ইবাদত বেশি বেশি করতে পারতেন। পক্ষান্তরে উম্মতে মুহাম্মদী স্বল্প আয়ু পাওয়া সত্ত্বেও যাতে ইবাদত বন্দেগীর দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভে তাঁদেরকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, সেজন্য মহান আল্লাহ দয়াপরবতা হয়ে এ রজনীর ব্যবস্থা করেছেন।
তবে, চার শ্রেণীর লোকেরা এ রাতের বরকত হতে বঞ্চিত হবেন। ১. শরাবখোর, ২. মাতাপিতার অবাধ্যচারী নাফরমানকারী সন্তান, ৩. আত্নীয়তার সম্পর্কচ্ছেদকারী, ৪. হিংসুক-নিন্দুক। (আত তারগীব ওয়াত তারহীব)
অন্যদিকে যারা বিশ্বাসগতভাবে মুনাফিক; ইসলাম ও কুফরের মাঝে যখন যেটা প্রয়োজন, সেটাকে গ্রহণ করে, এ রাতে তারাও বঞ্চিত হবে।
অবশ্য এ ধরনের পাপাচারে লিপ্তরা যদি খালেসভাবে তওবা করে এবং বাকী জীবন পুতপবিত্র হয়ে চলার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আল্লাহ তাদেরকে নিজ করুণা ও দয়ার মাঝে শামিল করে নেন।

লাইলাতুল কদর নির্ধারণ
লাইলাতুল কদর রমজানের শেষ দশকের কোন রাতটিতে, তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। বিভিন্ন হাদীস থেকে জানা যায় যে, রমজানের মাসের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতগুলোর মধ্যে কোন একটি অর্থাৎ ২১শে, ২৩ শে, ২৫ শে, ২৭ শে, বা ২৯ শে রাত হচ্ছে কদরের রাত।
হযরত আয়শা (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেন, “আমাকে শবে কদর দেখানো হয়েছে, তারপর আমি তা ভুলে গিয়েছি বা আমাকে ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। অতএব তোমরা রমযানের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর সন্ধান কর।” (বুখারী)
এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে যে লাইলাতুল কদরের রাতটির এই গোপনীয়তার রহস্য কী? আসলে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ রাতকে গোপন রেখেছেন আমাদের উপর রহম করেই। তিনি দেখতে চান, এই বরকত ও ফযীলত লাভের জন্য কে কত প্রচেষ্টা চালায়। কদরের রাতকে গোপন রাখার মধ্যে আছে আল্লাহ তায়ালার বিরাট হিকমত ও রহস্য। প্রত্যেক মূল্যবান বস্তু হাসিল করা যেমন কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তেমনি আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্য হলো এ মহামূল্যবান রাতের অনুসন্ধানে বান্দাগণ সাধনা করুক, শবে কদরের তারিখ গোপন থাকায় বেশ কিছু সুবিধা পেয়েছে, এ উম্মত।
এক. এ কারণে আজকেই শবে কদর কী না ভাবতে ভাবতে অনেকগুলো রাত ইবাদত করার সুযোগ হবে।
দুই. তা না থাকলে ঐ দিনটি ছুটে গেলে পরবর্তী রাতগুলোতে মনভরে ইবাদতের মাধ্যমে সে ক্ষতি পূরণের মানসিকতা থাকে না।
তিন. যতগুলো রাত এভাবে ইবাদতে কাটাবে প্রত্যেকটিরই স্বতন্ত্র প্রতিদান মিলবে।
চার. যারা স্বভাবজাত অপরাধী তারা জেনেশুনে ঐ নির্দিষ্ট রাত জানা সত্ত্বেও রাতটি অবহেলা করে খোদাদ্রোহিতা করত।
মহিমানি¦ত রজনীর নির্দশনাসমূহ
আবু মুনাযির (রা.) ও অন্যান্য সাহাবাগণের প্রশ্নের উত্তরে আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন যে, “এই রাতের পরবর্তী সকালে সূর্য আলোক রশ্মিহীন অবস্থায় উদিত হয়।” (মুসলিম)
এই রাতের আরও কিছু নিদর্শন এমন-
১. কদরের রাত তিমিরাচ্ছন্ন হবে না।
২. নাতিশীতোষ্ণ হবে।
৩. মৃদু বায়ু প্রবাহিত হবে।
৪. উক্ত রাতে মুমিনগণ ইবাদত করে অন্যান্য রাত অপেক্ষা অধিক তৃপ্তি পাবেন।
৫. ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে।
৬. হয়তোবা আল্লাহ তাঁর কোন ঈমানদার বান্দাকে তা স্বপ্নে দেখাবেন।

এ রাতে আমাদের করণীয়
রাসূলে কারীম (সা.) সর্বদা রমজানের শেষ দশ দিলেন এতেকাফ করতেন এবং স্বীয় পরিবার পরিজনকেও সজাগ রাখতেন। হযরত আয়েশা (রা.) বলেন, “রমজানের শেষ দশক এলে রাসূল (সা.) স্ত্রীদের থেকে পৃথক হয়ে যেতেন। নিজে সারা রাত ইবাদত করতেন এবং পরিবার-পরিজনদের ইবাদতের জন্য সজাগ করে দিতেন।” (বুখারী)
তাই আমাদের যা যা করা উচিতঃ

১) রাতের প্রথম অংশেই মাগরিব ও এশার সালাত আদায় করা।
২) রাতের কিছু অংশ কোরআন তেলাওয়াত ও অধ্যয়ন করা।
৩) বিশেষ একটি অংশে তারাবীহর সালাত ও নফল/ তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করা।
৪) বেশী বেশী যিকর, দরূদ, তাসবীহ পাঠ করা।
৫) তাওবা এস্তেগফার করা ও আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করা।
৬) দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণের জন্য বেশী করে দোয়া করা, কারণ এটি দোয়া কবুল হওয়ার সুবর্ণ সুযোগ।
৭) প্রয়োজন হলে বিশ্রাম নেয়া এবং সাহরী ও ফজরের সালাত আদায় করা।
৮) আল্লাহর রাসূল (সা.) আয়েশা (রা.)-কে এই রাতের জন্য একটি দোয়া শিখিয়ে দিয়েছেন, তা হলো : “আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহিব্বুল আফওয়া ফা’ফু আন্নী” অর্থাৎ “হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল! ক্ষমা করাকে তুমি পছন্দ কর, অতএব আমাকে ক্ষমা কর।” (আহমাদ, তিরমিযী)

কুরআন মাজীদ হচ্ছে complete code of life. মানুষের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত কুরআনের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্যই এই মহাগ্রন্থের আবির্ভাব। এই কুরআন এসেছে ইসলামকে সমস্ত মত ও পথের উপর বিজয়ী করতে। তাই যেই মহিমাময় কুরআনের জন্য লাইলাতুল কদর হয়েছে মহিমান্বিত। সেই কুরআনকে যদি আমরা আমাদের সারা জীবনের গাইড লাইন হিসেবে অনুসরণ না করি, তাহলে কদর রাতের ইবাদত নিছক আনুষ্ঠানিকতা বৈ আর কোন কল্যাণ বয়ে আনবে না। অতএব কদর রাতের যথাযথ ইবাদত ও আল কুরআনের প্রকৃত অনুসরণেই কেবল আমরা অবগাহন করতে পারবো ঐ রাতের রহমতের ঝর্ণাধারায়।

যাকাত

যাকাতের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
ইসলামের অন্যতম একটি স্তম্ভ হল যাকাত। এটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, পবিত্র কুরআনে যাকাত শব্দের উল্লেখ এসেছে বত্রিশ বার, অনেকবার সালাত এবং যাকাতকে একই আয়াতে প্রকাশ করা হয়েছে। সূরা আল বাকারার ১১০ নাম্বার আয়াতে আল্লাহ (সুবঃ) বলছেন, “তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত দাও। তোমরা নিজের জন্য পূর্বে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু কর নিশ্চয়ই আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন।” এছাড়াও যাকাত প্রদানকারী সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “তারা এমন লোক যাদেরকে পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ দান করলে তারা নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজে আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। প্রত্যেক কর্মের পরিমাণ আলর এখতিয়ারভুক্ত।” (সূরা আল-হাজ্বঃ ৪১)। যাকাতের শাব্দিক অর্থ হল বৃদ্ধি পাওয়া বা পরিশুদ্ধ হওয়া। আর আভিধানিক অর্থ হল ইসলাম নির্ধারিত সীমার অতিরিক্ত (সোনা ৭.৫ তোলা এবং রূপা ৫২.৫ তোলা মূল্যমানের সমান সম্পদের মালিক হলেই যাকাত ফরজ) সম্পদের মালিক প্রত্যেক পূর্ণবয়স্ক মুসলিম নর-নারী তার সম্পদের ২.৫ শতাংশ প্রতি বছর ইসলাম নির্দেশিত পন্থায় অসহায়, দরিদ্র মানুষের কল্যাণে ব্যয় করবেন।

যাকাতের উদ্দেশ্য

পরিপূর্ণ রূপে যাকাত এর হক আদায় করতে চাইলে আমাদের জানা উচিত যে, যাকাত কি জন্যে ফরয করা হয়েছে এবং কোন্ উদ্দেশ্য এর থেকে হাসিল করা যায়।আল কোরআন ও সুন্নাহতে এ সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে তা বিশ্লেষণ করলে জানা যাবে যে, যাকাতের তিনটি উদ্দেশ্য একটি বুনিয়াদী ও ব্যক্তিগত এবং অন্য দু’টি স্থানীয় ও সামাজিক।

১. আত্মশুদ্ধি

যাকাতের সত্যিকার এবং বুনিয়াদী উদ্দেশ্য হলো অন্তরের পবিত্রতা অর্জন। যাকাত দাতার অন্তর দুনিয়ার লোভ-লালসা থেকে পাক হবে এবং পাক হওয়ার পর নেকী ও তাকওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যাবে। আল কোরআনে বলা হয়েছে-‘এবং এই জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে ঐ ব্যক্তিকে যে আল্লাহকে ভয় করে,যে নিজের মাল অপরকে দান করে নিছক পাক হওয়ার জন্য।‘ (সূরা আল লাইল : ১৭-১৮)

‘তাদের ধন-সম্পদ থেকে তুমি সদকা গ্রহণ কর, যাতে করে তুমি তাদেরকে পাক-সাফ করতে পার এবং তাদের আত্মশুদ্ধি করতে পার।‘ (সূরা আত্ তওবা : ১০৩)

২. অভাবগ্রস্তদের স্বচ্ছলতা বিধান

যাকাতের দ্বিতীয় পর্যায়ের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে একটি হলো সমাজের নিঃস্ব লোকদের সাহায্য করা এবং তাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করা। নবী করীম (সা.) বলেছেন:

‘বস্তুত: আল্লাহ তাদের উপর যাকাত ফরয করেছেন। এ যাকাত তাদের ধনবানদের কাছ থেকে নেয়া হবে এবং বিতরণ করা হবে তাদের মধ্যে যারা অভাবগ্রস্ত।‘ (মুসলিম)

‘এবং তারা আল্লাহর প্রেমে ধন-সম্পদ দান করে আত্মীয়-স্বজনকে, এতীম-মিসকীন, মুসাফির ও সাহায্য প্রাথীকে এবং মুক্তি লাভের জন্যে।‘ (সূরা আল বাকারা : ১৭৭)

সুতরাং যাকাতের এই উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য যাকাতের মাল অভাবগ্রস্তদের অভাব পূরণের উপায় হয়ে যাওয়াটা একান্ত জরুরী।

৩. দ্বীনের সাহায্য

যাকাতের দ্বিতীয় পর্যায়ের উদ্দেশ্যগুলোর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হলো দ্বীনের রক্ষণাবেক্ষণ ও সাহায্য করা।

‘এ সাদকাসমূহ (যাকাত) গরীব মিসকীন ও সাদকা আদায়কারী কর্মচারীদের আর যাদেরকে সন্তুষ্ট করা আবশ্যক তাদের জন্যে। গোলাম মুক্ত করার জন্যে। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তিদের ঋণমুক্ত করার জন্য আল্লাহর পথে এবং বিদেশ ভ্রমণকারীদের জন্যে।‘ (সূরা আত্ তওবা : ৬০)

‘আল্লাহর পথে‘ অর্থাৎ আল্লাহর দ্বীনের জন্য যত চেষ্টা চরিত্র ও সংগ্রাম করা হবে তার জন্যে।

যাকাত ব্যবস্থা আসলে গোটা ইসলামী সমাজকে কৃপণতা, সংকীর্ণতা, স্বার্থপরতা, হিংসা, বিদ্বেষ, মনের কঠিনতা এবং শোষণ করার সূ² প্রবণতা থেকে পাক পবিত্র করে। এ কারণে যাকাত প্রত্যেক নবীর উম্মতের ওপর ফরয ছিল।

যাকাতের মূলনীতি

ইসলামী অর্থব্যবস্থায় যাকাতের ভ‚মিকা অপরিসীম। এটি এমন একটি বাস্তবসম্মত অর্থনীতি যা একটি ভারসাম্যপূর্ণ অর্থব্যবস্থা গঠনে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে।

তবে যাকাতের মাধ্যমে কাক্সিক্ষত কল্যাণ অর্জিত না হওয়ার কারণ হলো যাকাত আদায় ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে শরীয়াহর মূলনীতি অনুসরণ না করা। তাই কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে যে মূলনীতিগুলো পাওয়া যায় তা আমাদের জানা প্রয়োজন।

প্রথমত : যাকাত আদায় প্রতিটি সাহেবে নিসাব মুসলমান নর ও নারীর জন্যে বাধ্যতামূলক। সাহেবে নিসাব মুসলমান তার প্রদেয় যাকাত আদায় না করলে যেমন আখিরাতে ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হবে তেমনি ইহকালেও তাকে রাষ্ট্রের কঠোর কৈফিয়তের সম্মুখীন হতে হবে।

দ্বিতীয়ত : রাষ্ট্রই অর্থাৎ সরকারই যাকাত সংগ্রহ করবে তার নিজস্ব মেশিনারীর সাহায্যে।

রাসূলে করীম (সা.) যথাযথভাবে যাকাত আদায়ের জন্য প্রতিবছর বিভিন্ন অঞ্চলে এবং বড় বড় গোত্র প্রধানদের কাছে লোক পাঠাতেন। ঐসব নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা আদায়কৃত অর্থ, গবাদিপশু ও খাদ্যশস্য এনে জমা দিতেন বায়তুলমালে। এরপর সেখান হতেই যাকাতের হকদারদের মধ্যে তা বিলি বণ্টন করা হত। এ কাজের জন্য ঐ সময় আট ধরনের কর্মচারী নিযুক্ত ছিল।

তৃতীয়ত

কুরআনুল কারীমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যাকাতের প্রাপক হিসেবে যে আট শ্রেণীর লোকের কথা উল্লেখ করেছেন তাদের মধ্যেই যাকাতের অর্থ সম্পদ বণ্টন করতে হবে। ইরশাদ হয়েছে ‘যাকাত হলো কেবল ফকীর, মিসকীন, যাকাত আদায়কারী ও যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা দাসমুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য এবং মুসাফিরদের জন্য। এই হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান।‘ (সূরা আত্ তাওবাহ : ৬০)

যাকাত ওয়াজিব হওয়ার শর্ত

যাকাত ওয়াজিব হওয়ার শর্ত সাতটি- ১. মুসলমান হওয়া; ২. নেসাবের মালিক হওয়া; ৩. নেসাব প্রকৃত প্রয়োজনের অতিরিক্ত হওয়া; ৪. ঋণগ্রস্ত না হওয়া; ৫. মাল এক বছর স্থায়ী হওয়া; ৬. জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া; ৭. বালেগ হওয়া।

যাকাতের হার

একজন ব্যক্তি মূলধনের যে পরিমাণ মালিক হলে তার উপর যাকাত ফরয হয় সেই পরিমাণকে যাকাতের নেসাব বলা হয় এবং যে ব্যক্তির কাছে নেসাব পরিমাণ মূলধন থাকবে তাকে সাহেবে নেসাব বলা হয়।

একজন সাহেবে নেসাব ব্যক্তি যে হারে যাকাত আদায় করবেন :

  • কৃষিজাত ফসল উৎপন্নের জন্যে সেচ ব্যবস্থার প্রয়োজন হলে উৎপন্ন ফসলের বিশ ভাগের এক ভাগ, বৃষ্টির পানিতে ফসল উৎপন্ন হলে তার এক-দশমাংশ।
  • সঞ্চিত টাকা-পয়সা, সোনা-রৌপ্যর অলংকার এবং তেজারতি মালের শতকরা আড়াই ভাগ।
  • বনে-জঙ্গলে চরে বেড়ানো গৃহপালিত পশুর শতকরা দেড় থেকে আড়াই ভাগ।
  • খনিজ পদার্থের শতকরা বিশ ভাগ।

অর্থনৈতিক ভারসাম্য

যাকাতের অন্যতম বুনিয়াদী উদ্দেশ্য হলো অর্থনৈতিক ভারসাম্য সৃষ্টি। ধন আবর্তনশীল রাখার জন্যে এবং সমাজের সকল শ্রেণীর সুবিধা ভোগের জন্যে ধনশালী ও পুঁজিপতিদের নিকট থেকে যাকাত নেয়া হয় এবং তা দুঃস্থদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এতে করে ধন একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর নিকট সঞ্চিত না থেকে সমাজের সকল শ্রেণীর মধ্যে আবর্তনশীল হতে থাকে যা অর্থব্যবস্থার ভারসাম্য তৈরীতে সাহায্য করে।

যাকাত ও সামাজিক নিরাপত্তা

অর্থনৈতিক নিরাপত্তা সামাজিক নিরাপত্তার একটি প্রধান অংশ।

যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা সম্ভব।

১. যাকাত হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রধান ভিত্তি। যাকাতের হকদার হচ্ছে যারা কর্মক্ষমতাহীন এবং যারা কর্মক্ষমতা থাকা সত্তে¡ও উপার্জনহীন অথবা পর্যাপ্ত উপার্জন করতে পারছে না। যাকাতের মাধ্যমে এই সব মানুষকে অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দান সম্ভব।

২. যাকাতের মাধ্যমে অর্থনৈতিক পুনর্বাসন করা সম্ভব। রাষ্ট্রীয় তদারকিতে যাকাত অভাবগ্রস্তকে পর্যাপ্ত পরিমাণ দিতে হবে যাতে সে আর অভাবগ্রস্ত না থাকে।

হযরত ওমর (রা.) এর মত হচ্ছে,‘যখন দিবেই, তখন স্বচ্ছল বানিয়ে দাও।‘

৩. যাকাত সূত্রে ব্যক্তির প্রদেয় অর্থ সম্পদ রাষ্ট্রীয়ভাবে সংগৃহীত হলে বিশাল তহবিল গড়ে উঠতে পারে। সহস্র কোটি টাকা একত্রে পরিকল্পিতভাবে ব্যয়িত হলে যে বিশাল সামাজিক সুরক্ষা বলয় তৈরি হবে তাতে সমাজের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক দুঃস্থ ব্যক্তির নিরাপত্তার বিধান সম্ভব।

যাকাতের অসাধারণ গুরুত্বও মহত্বের কারণে আল কোরআনে বিরাশি স্থানে এর তাগিদ দেয়া হয়েছে। সাধারণত নামায ও যাকাতের কথা এক সাথে বলা হয়েছে। নামায মানুষকে আল্লাহর ভালবাসার দিকে নিয়ে যায় এবং যাকাত তাকে দুনিয়ার দিকে যাবার জন্য নিরাপদভাবে ছেড়ে দেয় না। এই আর্থিক ইবাদতের মাধ্যমে ব্যক্তি আত্মশুদ্ধির সুযোগ পায় যা তার মধ্যে কিছু মৌলিক গুণাবলীর বিকাশ করে।

যাকাতের মাধ্যমে তৈরি শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা বলয় যে কোন মুসলিম রাষ্ট্রকে দিতে পারে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার মর্যাদা। যা বিশ্বের বুকে অনুকরণীয় আদর্শ হতে পারে। তবে এ জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যথাযথভাবে যাকাত আদায় ও বণ্টন করা।

সমাজে প্রচলিত যাকাত ব্যবস্থা
যাকাত কোন দয়া দাক্ষিণ্যের নাম নয়। আল্লাহ (সুব:) পবিত্র কুরআনে সূরা আয-যারিয়াতের ১৯ নাম্বার আয়াতে এই বিষয়ে বলছেন, “এবং তাদের ধন সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের হক আছে।” সুতরাং যাকাত এমনই এক ব্যবস্থার নাম যার মাধ্যমে মুসলিমগণ সুযোগ পেয়ে থাকেন হকদারদের হক বুঝিয়ে দিতে। এই আয়াতের ভিত্তিতে বর্তমান প্রেক্ষাপটে যাকাত নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
আমাদের সমাজে অনেকে যাকাত দিচ্ছেন আবার অনেকে দিচ্ছেন না। আর যারা দিচ্ছেন তারা এমন এলোমেলোভাবে দিচ্ছেন যাকাতের প্রকৃত সুফল জনগণ লাভ করছে না, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। প্রতি বছর এক শ্রেণীর লোক যাকাত দেওয়ার নামে লোক দেখানো শাড়ি, লুঙ্গি বিতরণ করেন যেখানে হাজার হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন আর ভীড়ের চাপে মারা যান অনেকে। এইরকম অনৈসলামিক প্রক্রিয়ায় ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশে যাকাত ব্যবস্থাপনা হয়ে থাকে। আবার অনেকে যাকাতের অর্থকে এত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করেন যা দিয়ে যাকাতের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধন সম্ভব নয়। এমনকি যারা যাকাত নিতে আসেন তাদের আÍ-সম্মানবোধ বিসর্জন দিতে হয় যা হওয়ার কথা ছিল না। কারণ এটি তাদের হক।

একটি সুষ্ঠু যাকাত ব্যবস্থাপনা কি করে আমরা করতে পারি? যেখানে রাষ্ট্রব্যবস্থা সততার উপর নয়, সেখানে রাষ্ট্রের উপর নির্ভর করা যায় না, যেনতেন সংগঠনের উপরও নির্ভর করা যায় না। অনেক গবেষকের লেখা পর্যালোচনা করে আমার মনে হয়েছে ইসলামী সমাজ কাঠামো যেখানে প্রতিষ্ঠিত নয় সেখানেও অতি সফল যাকাত ব্যবস্থাপনা দাঁড় করানো সম্ভব। আজ সেই রকমই একটি যাকাত ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আলোকপাত করব।

বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে যাকাত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি কেমন হওয়া উচিত
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মসজিদের সংখ্যা ২,৫০,০০০ এর অধিক, প্রতিটি মসজিদকে ঘিরে গড় মুসলিমের সংখ্যা ৬০০ বা পঞ্চাশটি পরিবার। সুতরাং এটি এমন জটিল বিষয় নয় যে খুঁজে বের করা বা জানা এই ৫০টি পরিবারের মধ্যে কতটি পরিবার সমস্যায় রয়েছে কিংবা যাকাত প্রাপ্তির যোগ্য, অথবা কতটি পরিবার যাকাত প্রদানের যোগ্য? মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন এবং এলাকার সৎ পরহেজগার ইসলামের অনুসারী ব্যক্তিদের সমন¦য়ে পাঁচ হতে সাত সদস্যের একটি মসজিদ ভিত্তিক যাকাত কমিটি থাকতে হবে। এই কমিটিই যাকাত আদায় করবে এবং বিতরণ করবে। এতে সময়ের সাথে সাথে এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হার প্রকাশ্যে নিুগামী হতে বাধ্য।
অধিকন্তু প্রশ্ন জাগে উমর (রা.) এর গল্প বলা হুজুরগুলোর জানা থাকা উচিত নয় কি তাদের পিছনে নামাজ পড়া এই পঞ্চাশটি পরিবারের মধ্যে কোন পরিবারের মানুষ কি ধরনের সমস্যায় আছে? আজ যদি প্রতি ওয়াক্ত নামাজের পর উক্ত কমিটি সত্যি সত্যি পঞ্চাশটি পরিবারের খবর রাখতেন তাহলে কি জানা সম্ভব হতো না কারা না খেয়ে আছেন? কিংবা কারা ছেলেমেয়ের স্কুলের বেতন দিতে পারছে না? কিংবা কারা ঋণে জর্জরিত? দোষ কিন্তু ইসলামের ধ্বজাধারীদের ঘাড়ে গিয়েই পড়বে। প্রকৃত ইসলামী ব্যবস্থাপনায় মসজিদ ভিত্তিক যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণ নিশ্চিতে মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন, সৎ ও পরহেজগার ইসলামী অনুশাসন মানা লোকগুলো এগিয়ে আসলে এই দেশে দরিদ্র জনগোষ্ঠী থাকার কথা নয়। আর এই ব্যবস্থাপনার সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারে একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী ইসলামী সমাজ। যে সমাজ যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণে এগিয়ে থাকবে সে সমাজ জনকল্যাণে তত বেশি সম্পৃক্ত হতে পারবে।

তাগুত

আভিধানিক অর্থে তাগুত বলতে প্রত্যেক সীমালংঘনকারী ব্যক্তিকেই বুঝানো হয়। আল কোরআন ‘তাগুত’ কে নিজস্ব পরিভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছে। কোরআনের পরিভাষায় ‘তাগুত’ পূর্ব অর্থসহ সেই বান্দা বা সেই শক্তিকে বলা হয় যা বন্দেগী বা দাসত্বের সীমালংঘন করে নিজেই প্রভু ও মনিব হওয়ার ভান করে, আল্লাহর বান্দাহদেরকে নিজের বন্দেগী করতে বাধ্য করে। একজন বান্দাহর আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার তিনটি স্তর রয়েছে।

১ম স্তর : মানুষ নীতিগতভাবে আল্লাহর আনুগত্য ও হুকুম পালনকেই সঠিক বলে বিশ্বাস করবে ও মানবে। কিন্তু কার্যত তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করবে। এই স্তরে অবস্থানের নাম ফিসক।

২য় স্তর : মানুষ নীতিগতভাবেই আল্লাহর আনুগত্য লংঘন করে স্বেচ্ছাধীন হবে অথবা আল্লাহ ছাড়া অপর কারো বন্দেগী করবে। একে বলা হয় কুফর।

৩য় স্তর : এ পর্যায়ে মানুষ প্রকৃত মালিক আল্লাহর প্রতি বিদ্রোহী হয়ে তাঁর রাজ্যে ও তারই প্রজা সাধারণের উপর নিজের আইন ও হুকুমত চালাতে শুরু করে।

যে ব্যক্তি এই চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয় তাকেই বলা হয় তাগুত।

সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন প্রকার তাগুত

সমগ্র কুরআনে ৫ প্রকার তাগুতের সন্ধান পাওয়া যায়।

১. নফস ও হাওয়া : نفس অর্থাৎ নাফস অর্থ প্রবৃত্তি আর হাওয়া অর্থ কু-প্রবৃত্তি। দেহের যাবতীয় দাবীকে একসাথে নাফস বলা হয়। যে দাবী মন্দ তাকেই হাওয়া বলে। দেহের ভাল ও মন্দের কোন ধারণা নেই। এ ধারণা আছে বিবেকের। রুহের সিদ্ধান্তই বিবেক। নাফস বা দেহের দাবি মন্দ বলেই ধরে নিতে হবে। বিবেক যাচাই করে .. দেয় কোন দাবিটা ভালো বা মন্দ। সূরা ইউসুফের ৫৩ নং আয়াতে বলা হয়েছেÑ

إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ

‘নিশ্চয়ই নাফস মন্দেরই হুকুম দেয়।‘ আল্লাহর নাফরমানীর জন্য তাগিদ দেয় বলেই নাফস তাগুত।

যদি কেউ সত্যিই আল্লাহর অনুগত  বান্দাহ হতে চায়, তাহলে তাকে অবশ্যই নাফসের কাফির হতে হবে। কেউ যদি উন্নত চরিত্রের অধিকারী হতে চায় তাহলে প্রথমেই তাকে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমি নফসের কথা মেনে চলব না; অর্থাৎ আমি বিবেকের বিরুদ্ধে চলবো না।

এ সিদ্ধান্ত না মেনে নিলে সে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা সত্তে¡ও নাফসের গোলামই থেকে যাবে। সে আল্লাহকে ইলাহ বা হুকুমকর্তা স্বীকার করা সত্তে¡ও নফস বা হাওয়াকে ইলাহ হিসেবেই মেনে চলবে।

সূরা জাছিয়ার ২৩ নং আয়াতে আছে-

أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَٰهَهُ هَوَاهُ

‘তুমি কি তাকে দেখেছ, যে তার কুপ্রবৃত্তিকে ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করেছে?‘

কুরআনের অনুবাদে অনেকেই তাগুত অর্থ লিখেছেন শয়তান। শয়তান আল্লাহর নাফরমানী করার জন্য উসকে দেয় বলে শয়তান অবশ্যই তাগুত। কিন্তু তাগুত অর্থ শয়তান নয়। শয়তান মানুষের নাফসকে বিভ্রান্ত করেই নাফরমানীর জন্য ওয়াসওয়াসা দেয়। তাই প্রথম নম্বর তাগুতের মধ্যেই শয়তান অন্তর্ভুক্ত।

২ শরীয়াত বিরোধী প্রচলিত কু-প্রথা ও সামাজিক কু-সংস্কার ও তাগুত

সূরা বাকারায় আল্লাহ বলেন-‘যখন তাদেরকে বলা হলো যে, আল্লাহ যা (ওহী যোগে) নাযিল করেছেন তা মেনে চল, তখন তারা বলল, আমাদের বাপ-দাদাকে যা মেনে চলতে দেখেছি আমরা তাই মেনে চলব।‘ (সূরা বাকারা : ১৭০)

সমাজে বহু কুপ্রথা প্রচলিত যা শরীয়াত বিরোধী। ধর্মের নামেও বহু শরীয়াত বিরোধী প্রথা চালু আছে। বিয়ে- শাদিতে তো কুপ্রথার ব্যাপক প্রচলন আছে। কুপ্রথাগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী। এসবকে অমান্য করতে গেলে বিরাট বাধার সম্মুখীন হতে হয়। কুপ্রথাগুলো আইনের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। আইন চালু করতে হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার (খধি ঊহভড়ৎপবরহম অমবহপু) প্রয়োজন হয়। কুপ্রথা নিজের শক্তি বলেই চালু থাকে। আইন করে ও তা দূর করা সহজ নয়।

এ কারণেই সামাজিক কুসংস্কারগুলো ও তাগুত। এ সবকে মানতে অস্বীকার না করলে ঈমানের দাবি পূরণ করা যায় না। এগুলো আল্লাহর হুকুমের বিরোধী। এ সবকে মেনে চললে আল্লাহকে অমান্য করা হয়।

৩. শাসন শক্তি : কারও উপর কর্তৃত্ব করার সুযোগ যার আছে সেই হলো শাসন শক্তি। একটি দেশের সরকার হলো সবচেয়ে শক্তিশালী শাসন শক্তি। শাসন শক্তি বললে শুধু গভর্নমেন্টই বোঝায় না। স্বামী-স্ত্রীর সংসারে স্বামীও শাসন শক্তি। পরিবারের পিতা শাসন শক্তি। কোন প্রতিষ্ঠানের প্রধানও শাসন শক্তি। কুরআনে ফিরাউন ও নমরুদকে শাসন শক্তি হিসেবে তাগুত বলা হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা মুসা (আ.) কে ফিরাউনের নিকট যাওয়ার আদেশ যে ভাষায় দিলেন, সেখানেও ফিরাউনকে সীমালংঘনকারী বলেই উল্লেখ করেছেন :

‘হে মুসা! ফিরাউনের নিকট যাও, নিশ্চয়ই সে সীমালংঘন করেছে।‘ (সূরা ত্বহা : ২৪)

৪. রিযিক বন্ধ করে দেওয়ার ভয় দেখানোর শক্তি

এ প্রকার তাগুতটি শাসন শক্তিরই অন্তর্ভুক্ত। চাকরি থেকে সরিয়ে দিয়ে রিযিক বন্ধ করার ক্ষমতা যাদের আছে তারা শাসন শক্তি বটে। তবু এটা পৃথকভাবে গণ্য করার যোগ্য তাগুত। শাসন শক্তি প্রয়োগ করে অন্যায়ভাবে বিভিন্ন ধরনের শাস্তি দিতে পারে ও বিভিন্নভাবে ক্ষতি করতে পারে কিন্তু চাকরি থেকে বরখাস্ত শাস্তিটি চরম জুলুম বলেই রিযিক বন্ধ করার ভয় দেখানোর শক্তিকে শাসন শক্তি থেকে আলাদা ভাবে গণ্য করা হলো। এ শক্তি প্রয়োগ করে অধীনস্থদেরকে আল্লাহর নাফরমানী করতে বাধ্য করা যায় বলেই এটাও তাগুত।

৫. অন্ধভাবে মেনে চলার দাবিদার শক্তি তাগুত

সমাজে এমন কতক লোক আছে যারা তাদেরকে তাগুত ভাবে মেনে চলার জন্য নৈতিক প্রভাব প্রয়োগ করতে সক্ষম তাদের দাবি হলো, বিনা যুক্তিতে তাদের কথা মেনে চলতে হবে।বিনা প্রশ্নে তাদের আনুগত্য করতে হবে। বিনা বাক্য ব্যয়ে তাদের হুকুম পালনের অধিকার তারা দাবি করে।

অথচ আল্লাহ ও রাসূল (সা.) ছাড়া এ দাবি করার আর কারো অধিকার নেই। যেহেতু আল্লাহ নির্ভুল এবং রাসূল (সা.) আল্লাহর ওহী দ্বারা পরিচালিত বলে তিনিও নির্ভুল, সেহেতু এ দুসত্তাকে বিনা দ্বিধায় শর্তহীনভাবে মেনে চলতে হবে। এছাড়া আর কারো এ জাতীয় আনুগত্যের দাবিদার হওয়ার অধিকার নেই। তাই যারা এ দাবি করে তারাও তাগুত।

সূরা তওবার ৩১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ

‘তারা তাদের ওলামা ও পীরদেরকে আল্লাহর বদলে তাদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে।‘

মূর্তি, কবর, স্মৃতিস্তম্ভ বা কাল্পনিক কোন শক্তি, আলেম, মুজাহিদ, পন্ডিত, বুুদ্ধিজীবী, গণক, ভবিষ্যত বক্তা, নেতা-নেত্রী যাদেরকে কোরআন ও সুন্নাহর দেওয়া সীমানার বাইরে অনুসরণ করা হয়, যাদের কথা ও কাজকে কোরআন ও সুন্নাহর দলিলের মত মনে করা হয় তারাও তাগুত।

আল কুরআনে তাগুত সম্পর্কিত বক্তব্য

আল কুরআনে তাগুত সম্পর্কিত আলোচনা হয়েছে মোট ৮টি স্থানে।

১. দ্বীনের ব্যাপারে কোন জোর জবরদস্তি নেই। প্রকৃত শুদ্ধ ও নির্ভুল কথা সুস্পষ্ট এবং ভুল চিন্তাধারা হতে সম্পূর্ণ পৃথক হয়ে গেছে। এখন যে কেউ তাগুতকে অস্বীকার করে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে সে এমন এক শক্তিশালী অবলম্বন ধরেছে, যা কখনই ছিঁড়ে যাবার নয় এবং আল্লাহ (যার আশ্রয় সে গ্রহণ করেছে) সবকিছু শ্রবণ করেন এবং সব কিছু জানেন। (সূরা বাকারা : ২৫৬)

২. যারা ঈমান আনে, তাদের সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক হচ্ছেন আল্লাহ: তিনি তাঁদেরকে অন্ধকার হতে আলোকের দিকে বের করে আনেন। আর যারা কুফরী অবলম্বন করে, তাদের সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক তাগুত। উহা তাদেরকে আলো হতে অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যায়। এরা হবে জাহান্নামী, সেখানে তারা চিরদিন থাকবে।‘ (সূরা বাকারা : ২৫৭)

৩. হে নবী, তুমি কি সেইসব লোকদের দেখ নাই, যারা দাবী করে যে, আমরা ঈমান এনেছি সেই কিতাবের প্রতি যা তোমার প্রতি নাযিল হয়েছে এবং যা তোমার পূর্বে নাযিল হয়েছিল, কিন্তু তারা নিজেদের যাবতীয় ব্যাপারে ফয়সালার জন্য তাগুতের নিকট পৌঁছতে চায়। অথচ তাগুতকে সম্পূর্ণ অস্বীকার ও অমান্য করতে তাদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছিল। মূলত শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করে সত্য সরল পথ হতে বহু দূরে নিয়ে যেতে চায়। তাদেরকে যখন বলা হয় যে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সেই দিকে আস এবং রাসূলের নীতি গ্রহণ কর, তখন এই মুনাফিকদের তুমি দেখতে পাবে যে তারা তোমার নিকট আসতে ইতস্ততঃ করছে এবং পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। (সূরা নিসা : ৬০)

৪. যারা ঈমানের পথ গ্রহণ করে তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে আর যারা কুফরী পথ অবলম্বন করে তারা লড়াই করে তাগুতের পথে।‘ (সূরা নিসা : ৭৬)

৫. তুমি কি সেই লোকদের দেখ নাই, যাদেরকে কিতাবের জ্ঞানের একাংশ দেওয়া হয়েছে এবং তাদের অবস্থা এই যে, তারা জিব্ত ও তাগুতকে মেনে চলছে এবং কাফেরদের সম্পর্কে বলে যে, ঈমানদার লোক অপেক্ষা এরাই তো সঠিক পথে চলছে। বস্তুত: এইসব লোকের উপরই আল্লাহ তাআলা লা’নত করেছেন, তারা কোন সাহায্যকারী পাবে না। (সূরা নিসা: ৫১)

৬. যারা তাগুতের দাসত্ব করা থেকে দূরে থাকে এবং আল্লাহর অভিমুখী হয় তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। (সূরা যুমার : ১৭)

৭. আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি এই নির্দেশ দেয়ার জন্য যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে দূরে থাক। (সূরা নাহল : ৩৬)

৮. বলুন, আমি তোমাদেরকে বলি, কাদের জন্য মন্দ প্রতিফল রয়েছে আল্লাহর কাছে? যাদের প্রতি আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন, যাদের প্রতি তিনি ক্রোধানি¦ত হয়েছেন, যাদের কতককে বানরে ও শূকরে রূপান্তরিত করেছেন এবং যারা তাগুতের আরাধনা করেছে, তারাই মর্যাদার দিক দিয়ে নিকৃষ্টতর এবং সত্যপথ থেকে অনেক দূরে। (সূরা মায়েদা : ৬০)

আল কুরআন তাগুত সম্পর্কিত আয়াতসমূহ থেকে যে মূলনীতি ঘোষণা করেছে

১.ঈমান আনার অপরিহার্য শর্ত তাগুতকে অস্বীকার করা।

২.কুফরী পথের সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক তাগুত।

৩.তাগুত আল্লাহর বান্দাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারের পথে নিয়ে যায়।

৪.তাগুতকে সম্পূর্ণ অস্বীকার ও অমান্য করার আদেশ দেওয়া হয়েছে তথাপি মানুষ বিচার ফয়সালার জন্য তাগুতের কাছে যেতে চায়।

৫.তাগুতের পথ অবলম্বনকারীরা আল্লাহর নাযিলকৃত পদ্ধতির এবং রাসূলের নীতির দিকে আহ্বান জানালে ইতস্ততঃ করে এবং পাশ কাটিয়ে চলে যায়।

৬.ঈমানদার লড়াই করে আল্লাহর পথে আর কাফের লড়াই করে তাগুতের পথে।

৭.তাগুত অবলম্বনকারীরা বলে তারা ঈমানদারদের থেকে অধিকতর সঠিক পথে রয়েছে।

৮.তাগুত অবলম্বনকারীদের প্রতি আল্লাহ লা’নত বর্ষণ করেছেন। তারা কোন সাহায্যকারী পাবে না।

৯.আল্লাহর দাসত্ব করা এবং তাগুত থেকে দূরে থাকার নির্দেশনা দেওয়ার জন্যই আল্লাহ রাসূল প্রেরণ করেছেন।

তাগুতের অনিষ্টকারিতা

‘হে মানবজাতি! তোমাদের প্রতি আল্লাহর যে অনুগ্রহ রয়েছে, তোমরা তা স্মরণ করো। আল্লাহ ছাড়া এমন কোন স্রষ্টা আছেন কি যিনি আসমান-জমীন থেকে তোমাদেরকে রিযিক দেন? তিনি ছাড়া আর কোন ইলাহ নেই। তবু তোমরা কোথায় ছুটে বেড়াচ্ছ?‘ (সূরা আল ফাতির : ৩)

মানব সমাজে তাগুতের অনিষ্টকারিতা ভয়াবহ। মহান সত্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষকে সে সর্বোচ্চ যোগ্যতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, তাতে সে শুধু সর্বোচ্চ শক্তিমান আল্লাহরই আনুগত্য করতে পারে। তার চেয়ে কম শক্তিশালী কোন সত্তার তথা তাগুতের আনুগত্য মানুষের মর্যাদাকে বিনষ্ট করে। তাগুতের ফলে মানুষ বিকৃত জীবনব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফলশ্র‘তিতে পৃথিবী তার স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে হারিয়ে ফেলবে।

তাগুত সর্বদাই আল্লাহর দাসত্ব থেকে ফিরিয়ে রেখে আল্লাহ বিরোধী শক্তির দাসত্ব করতে বাধ্য করে। আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার জন্য তাগুতকে প্রত্যাখ্যান  করা অপরিহার্য।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাগুতকে অস্বীকার করার জন্য সঠিক উপলব্ধি এবং দৃঢ়তা নিয়ে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ-এই কালেমার উপর পরিপূর্ণ ঈমান নিয়ে আল্লাহ তায়ালার সঠিক আনুগত্য করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

রমযান

সিয়াম সাধনায় আল্লাহর রাসূল (সা:)

‘রমযান সেই মাস, যে মাসে মানবজাতি পথ প্রদর্শন, পথ প্রদর্শনের উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহ এবং ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী কুরআন নাযিল করা হয়েছে। অতএব যে ব্যক্তি এ মাসটি পেল সে যেন অবশ্যই রোযা রাখে।‘  (সূরা আল বাকারা : ১৮৫)

রমযানুল মুবারক, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অসীম রহমতের সাগরে দুনিয়াতে প্রকাশপ্রাপ্ত সবচেয়ে বড় জলোচ্ছাস যেন। কুরআন নাযিলের ঘটনা এবং সেই সাথে আল্লাহর রহমত, বরকত, মাগফেরাতের ভান্ডার থেকে সবকিছু অর্জনের সর্বোত্তম সুযোগ এই মাসকে করেছে মহিমান্বিত। এই সর্বোত্তম মাসটিকে সর্বোত্তমভাবে পালনের জন্য আমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ হিসেবে আছেন মুহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা.); যার ব্যাপারে কুরআনের ভাষ্য ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহর জীবনে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।‘ (সূরা আহযাব : ২১)

অতএব, রাসূল (সা.)-এর রমজান পালনের দিকগুলো সামনে রেখে, সেভাবেই যদি আমরা এই পবিত্র মাস উদযাপন করতে পারি, তবেই এই সর্বোত্তম মাসটি থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ নেকী অর্জন সম্ভব।

রাসূল (সা.) এর জীবনাচরণ বিশ্লেষণ করলে, আমরা দেখব, রমযানের পূর্বকালীন সময় থেকে রমজানের সর্বোত্তম পবিত্রতা রক্ষা করে রাসূলে পাক (সা.) এ সময়ে প্রতিটি মুহ‚র্তকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের প্রয়াসে কিভাবে ব্যয় করেছেন।

রমজানের পূর্ব প্রস্তুতি

রমজান মাসের পূর্ব থেকেই রাসূল (সা.) এই মাসকে বিশেষভাবে পালনের জন্য কিছু পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। যেমনÑ রমজানের পূর্বে শা’বান মাসেই রাসূল (সা.)-এর ইবাদত বেড়ে যেত। শা’বান মাসের প্রায় পুরোটাই তিনি রোজা রাখতেন। তবে রমজানের এক বা দু’দিন আগে রোজা রাখতেন না। এ প্রসঙ্গে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেন, ‘তোমরা কেউ রমজানের একদিন কিংবা দু’দিন আগে হতে সাওম শুরু করবে না। তবে কেউ যদি এ সময় সিয়াম পালনে অভ্যস্ত থাকে, তাহলে সে সেদিন সাওম পালন করতে পারবে।‘ (বুখারী ও মুসলিম)

এছাড়াও রাসূল (সা.) রমজান আগমনের পূর্বে নিজের সাহাবীদেরকে উদ্দেশ্য করে এ মাসের মহত্ব এবং বরকত সম্পর্কে আলোচনা করতেন এবং এ মাসের বরকতের ভান্ডার থেকে নিজেদের পরিপূর্ণ অংশ সংগ্রহ করার জন্য ব্যাপক পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার তাগিদ দিতেন। এ সংক্রান্ত রাসূল (সা.)-এর কিছু বর্ণনা :

‘রমজান মাসের আগমনে আসমানের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়। আর শয়তানগুলোকে শিকলবন্দী করা হয়।‘ (বুখারী)

‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে একটি ফরয আদায় করলো সে ঐ ব্যক্তির সমতুল্য যে অন্য সময় সত্তরটি ফরয আদায় করলো।‘ (বায়হাকী)

‘আদম সন্তানের প্রত্যেকটি কাজ দশ থেকে সাতশতগুণ বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু আল্লাহ বলেন, রোজাকে এর মধ্যে গণ্য করা হবে না। কারণ রোজা কেবলমাত্র আমার জন্য, আর আমিই এর প্রতিফল দিব।‘ (বুখারী ও মুসলিম)

‘জান্নাতে আটটি দরজা আছে। এর মধ্যে একটির নাম ‘রাইয়ান’। রোজাদাররা ছাড়া আর কেউ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না।‘ (বুখারী, মুসলিম)

এভাবেই রাসূল (সা.) এই মহিমানি¦ত মাসটির গুরুত্ব ও ফযিলত বর্ণনা করে সাহাবীদের এই মাস উদযাপনের জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নিতে উদ্বুদ্ধ করতেন।

রাসূল (সা.) এর রমজান

রাসূল (সা.) এই রমযান মাসকে ‘শাহরুল আযিম‘ এবং ‘শাহরুম মোবারক‘ নামে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ এ মাসটি হচ্ছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মহান মাস, বরকতের মাস। রাসূল (সা.) এই বিশেষ সময়টিতে বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকতেন এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীদেরকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। রাসূল (সা.) এই সময়ে বিশেষভাবে কিছু ইবাদত করতেন। যেমন-

কুরআন তিলাওয়াত

রমজান মাসের বরকত ও মহত্বের অন্যতম প্রধান কারণটি হচ্ছে এ মাসে পবিত্র কুরআন নাযিল করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা একথাটি এভাবে এরশাদ করেছেনÑ

‘রমজান সেই মাস, যে মাসে মানবজাতির পথ প্রদর্শন, পথ প্রদর্শনের উজ্জ্বল নিদর্শনসমূহ এবং ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী কুরআন নাযিল হয়েছে। অতএব যে ব্যক্তি এ মাসটি পেল সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে।‘ (সূরা আল বাকারা : ১৮৫)

রমজান মাসে রাসূল (সা.) অন্যান্য সময়ের তুলনায় কুরআন তিলাওয়াতের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন। এ মাসে তিনি জিবরাঈল (আ.) এর কাছে কুরআন শিখতেন। হাদীসে বর্ণিত আছে যে, এই সময় তিনি জিবরাঈল (আ.)-কে কুরআন পড়ে শুনাতেন।

কিরামে লাইল

পবিত্র রমজান মাসে রাসূল (সা.) দাঁড়িয়ে কুরআন তিলাওয়াত শ্রবণ, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়ার কাজকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতেন। এজন্য তিনি দু’টি সময়কে বেঁছে নিতেন। তা হলোÑ রাতের প্রথমাংশে বা মধ্যভাগে তারাবীহ নামাযে দাঁড়ানো এবং মধ্যরাতের পর বা রাতের শেষ তৃতীয়াংশে তাহাজ্জুদের নামাযে দাঁড়ানো।

তারাবীহর সালাত

আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন-‘যে ব্যক্তি রমজানের ঈমানের সাথে সওয়াব লাভের আশায় কিয়ামে রমজান অর্থাৎ তারাবীহর সালাত আদায় করবে তার পূর্ববর্তী গোনাহসমূহ ক্ষমা করা হবে।‘ (বুখারী)

আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসূল (সা.) একদিন রমজানের রাতের মধ্যভাগে বের হলেন, অতঃপর মসজিদে নামায পড়লেন এবং কিছু লোক তাঁর পিছনে সালাত আদায় করলো। দ্বিতীয় দিন এর চাইতে অধিক মানুষ জামাতে শামিল হলো। তৃতীয়-দিন মুসল্লির সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। চতুর্থ রাতে, মসজিদের ধারণ ক্ষমতার অধিক মানুষ হলো, কিন্তু এ রাতে তিনি আর বের না হয়ে ফজরের সালাত আদায়ের সময় আসলেন এবং সালাত আদায় শেষে লোকদের দিকে ঘুরে বললেন- তোমাদের অবস্থা আমার অজানা নেই, কিন্তু আমি এই সালাত তোমাদের উপর ফরজ হবার আশংকায় রাতে বের হইনি। কেননা তোমরা তা আদায় করতে অক্ষম হয়ে পড়বে। অতঃপর রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকাল হলো আর ব্যাপারটি এভাবে থেকে গেল।‘

তারাবীহ’র সালাত ফরয না হলেও, রাসূল (সা.) ও তাঁর সাহাবাগণ বিশেষ গুরুত্বসহকারে নিয়মিতভাবে দীর্ঘ কুরআন তিলাওয়াত সহকারে এই সালাত পড়তেন।

তাহাজ্জুদের নামায

আবু সালামাহ ইবনু আবদুর রহমান (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি আয়েশা (রা.)-কে জিজ্ঞেস করেন যে, রমজানে (রাতে) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নামায কেমন ছিল? তিনি জবাব দিলেন, ‘রমজানে এবং রমজান ব্যতীত অন্য সময় এগার রাকআতের বেশি তিনি পড়তেন না। প্রথমত তিনি চার রাকাআত পড়তেন। এ চার রাকআতের সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্বন্ধে তুমি কোন প্রশ্ন করো না। তারপর আরও চার রাকাআত পড়তেন। এর সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্বন্ধে (আর কি বর্ণনা দিব, কাজেই কোন) জিজ্ঞাসাই করোনা। এরপর পড়তেন বিতরের তিন রাকাআত। আমি (আয়িশা রা.) বলতাম, ‘ হে আল্লাহর রাসূল- আপনি বিতর আদায়ের আগে ঘুমিয়ে যাবেন।‘ তিনি বলতেন : ‘হে আয়শা, আমার দু’চোখ ঘুমায় বটে কিন্তু আমার কালব নিদাচ্ছন্ন হয় না।‘ (সহীহ আল বুখারী, হাদীস নং-১৮৭০)

তিনি এতো দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতেন যে তাঁর পা ফুলে যেতো, আয়শা (রা.) বলতেন, ‘হে রাসূল, আল্লাহ তো আপনাকে ক্ষমা করেই দিয়েছেন, তাহলে এতো কষ্ট করছেন কেন?‘ রাসূল (সা.) বলতেন, ‘আমি কি আল্লাহর শোকরগুজার বান্দা হবো না।‘

রমজানের শেষ দশ দিনের আমল

আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন রমজানের শেষ দশক আসত, তখন নবী (সা.) তার কাপড় (লুঙ্গি) কষে বেঁধে নিতেন (বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন। রাসূল রমজানের শেষ দশ দিনে অধিক পরিমাণে ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল হয়ে যেতেন। এই দিনগুলোর ইবাদতের দু’টি বিশেষ ধরন হচ্ছে-১. শবে কদর বা লাইলাতুল ক্বদর অন্বেষন , ২. ইতিকাফ।

লাইলাতুল ক্বদর অন্বেষন

‘নিশ্চয়ই আমি নাযিল করেছি এ কুরআন মহিমান্বিত রাতে। আর আপনি কি জানেন ‘মহিমান্বিত রাত’ কি? মহিমান্বিত রাত হাজার মাস অপেক্ষাও শ্রেষ্ঠ।‘ (সূরা ক্বদর:১-৩)

কুরআন নাযিলের রাত হিসেবে লাইলাতুল ক্বদর এক অনন্য মর্যাদার অধিকারী। এ রাতের ব্যাপারে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা বিশ্ববাসীর খুব নিকটে আসেন এবং ডেকে বলেন, কে আছ এমন যে আমার কাছে যা চাইবে, তাকে তাই দেবো, কে আছে এমন, যে আমার কাছে নিজের গুনাহ মাফ চাইবে আর আমি তাকে মাফ করে দেবো।‘ (বুখারী, মুসলিম)

লাইলাতুল ক্বদর-এর রাত কোনটি এ ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট ঘোষণা আল্লাহ বা তাঁর রাসূল দেননি। এ ব্যাপারে রাসূল (সা.) বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে লাইলাতুল ক্বদর-এর সংবাদ দেবার জন্য বের হয়েছিলাম, তখন তোমাদের দুই ব্যক্তি ঝগড়া করছিল। ফলে এই রাতের নির্দিষ্ট তারিখের পরিচয় হারিয়ে যায়। সম্ভবত: এর মধ্যে তোমাদের জন্য কল্যাণ নিহিত আছে। তোমরা রমজানের শেষ দশকে বেজোড় রাতে লাইলাতুল ক্বদরের অনুসন্ধান কর।‘ (বুখারী)

রাসূল (সা.) রমজানের শেষ দশ রাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ক্ষমা প্রাপ্তির জন্য সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত থাকতেন এবং বিরামহীন ইবাদত করতেন। রাসূল (সা.) এই সময়ে একটি বিশেষ দোয়া বেশি করে পড়তেন-

‘আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন তুহীব্বুন আফওয়া ফা’ফু আন্নী‘Ñ (আমহদ, তিরমিযী)

অর্থঃ ‘হে আমার আল্লাহ, তুমি মহান ক্ষমাশীল, ক্ষমা প্রার্থনা তোমার নিকটে খুবই প্রিয়, অতএব, আমাকে ক্ষমা করে দাও।‘

ই’তিকাফ

আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী (সা.) রমজানের শেষ দশকে ই’তিকাফ করতেন। ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি এ নিয়ম পালন করেছেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর স্ত্রীগণ ই’তিকাফের এ ধারা অব্যাহত রাখেন। (বুখারী)

ই’তিকাফ শব্দের অর্থ কোন স্থানে স্থির থাকা, অবস্থান করা বা আবদ্ধ থাকা। শরীয়তের পরিভাষায়, আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে দুনিয়াবী অপ্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মসজিদে বা নিভৃত স্থানে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকা।

আল্লাহর রাসূল (সা.) রমজানের শেষ দশদিন ই’তিকাফে বসতেন এবং যিকির, তাসবীহ, তাকবির, ইস্তেগফার দরূদ পাঠ, কুরআন তিলাওয়াত, সালাত আদায় সহ সব ধরনের ইবাদতের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতেন।

দান-সাদকাহ

রাসূল (সা.) রমজান মাসে সবচেয়ে বেশি দান করতেন। ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (রা.) ধন-সম্পদ ব্যয় করার ব্যাপারে সকলের চেয়ে দানশীল ছিলেন। রমজানে জিবরাঈল (আ.) যখন তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতেন, তখন তিনি আরো অধিক দান করতেন। রমজান শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রাতেই জিবরাঈল (আ.) তাঁর সঙ্গে একবার সাক্ষাত করতেন। আর নবী (সা.) তাঁকে কুরআন শোনাতেন। জিবরাঈল যখন তাঁর সাথে সাক্ষাত করতেন তখন তিনি রহমতসহ প্রেরিত বায়ুর চেয়ে অধিক ধন-সম্পদ দান করতেন।‘ (বুখারী)

রাসূল (সা.)-এর সাহরী ও ইফতার

রাসূল (সা.) অনেক সময় না খেয়েও রোজা রেখেছেন। তবে সাহরী খাওয়ার ব্যাপারে তিনি উৎসাহ দিয়েছেনÑ ‘তোমরা সাহরী খাও, কেননা সাহরীতে বরকত রয়েছে।‘ (বুখারী)

রাসূল (সা.) সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করতেন। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘লোকেরা যতদিন শীঘ্র ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে, ইফতারে পানি, খেজুর বা যা সহজলভ্য এমন কিছু দিয়ে-ই রোজা ভাঙ্গা রাসূল (সা.) পছন্দ করতেন। তিনি দ্রুত ইফতার করতেন এবং মাগরিবের নামায ও তাড়াতাড়ি পড়তেন। একা ইফতার করতেন না। অভাবীদের ইফতার করাতে বিশেষভাবে পছন্দ করতেন। রাসূল (সা.) বলেছেন : ‘ যে ব্যক্তি এ মাসে কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে, তার গুনাহ মোচন ও জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি অবধারিত।‘ (বায়হাকী)

রোজা অবস্থায় যে সব কাজ করা রাসূল (সা.) বিশেষভাবে অপছন্দ করতেন

রোজার আরেক অর্থ হচ্ছে ‘বিরত থাকা’। মানুষের প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার প্রশিক্ষণই আমরা রমজান থেকে পেয়ে থাকি। রাসূল (সা.) রোজা অবস্থায় কিছু কাজ করাকে খুবই অপছন্দ করতেন।

জাবির (রা.) বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন-পাঁচটি ব্যাপারে রোজাদারের রোজা বরবাদ করে দেয়। যথা-

১. মিথ্যা বলা; ২. চোগলখুরি বা ক‚টনামি করা; ৩. পেছনে নিন্দা করা বা গীবত; ৪. মিথ্যা কসম করা ও ৫ কামভাব নিয়ে দৃষ্টিপাত করা।

এছাড়া রোজা রাখা অবস্থায় ঝগড়া করা, গালি-গালজ করাকেও রাসূল (সা.) অত্যন্ত গর্হিত কাজ হিসেবে বলেছেন। কোন রোজাদারের সাথে কেউ ঝগড়া করতে আসলে বা তাকে গালি দিলে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সে যেন বলে, আমি রোজাদার বা সায়িম।‘ (বুখারী)

রমজান পরবর্তী সময়ে রাসূল (সা.)

সর্বোপরি, কুরআন ও ইসলামের মৌলিক দাবী নিজের জীবনে এবং সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি সারা জীবন ধরে প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। রমজানের তাকওয়া অর্জনের এই প্রশিক্ষণের বীজ সারাবছর ধরেই ফুলে-ফলে শোভিত এক বৃক্ষে পরিণত হতো যেন রাসূল (সা.) এর জীবনে।

এভাবেই, একজন সফল রোজাদারের প্রকৃত প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হতে দেখি আমরা রাসূল (সা.)-এর সিয়াম সাধনায়, রমজান পালনের ব্যাপারে এই মহামানবের জীবনী-ই আমাদের জন্য সর্বোত্তম ও প্রকৃত আদর্শ। কিন্তু বর্তমানে, রোজা রাখা অবস্থায় অহেতুক গল্প করে, টি.ভি, দেখে, ঘুমিয়ে সময় নষ্ট করা; তারাবীহর নামায, তাহাজ্জুদের নামায, কোরআন তিলাওয়াতসহ অন্যান্য ইবাদতে উদসিনতা দেখিয়ে সেহরী, ইফতারের রসনা বিলাস ও অহেতুক ঈদ শপিং-এ ব্যস্ত থেকে সময় নষ্ট করার যে সংস্কৃতি আমরা চালু করেছি, তা রাসূল (সা.)-এর সুন্নাতের সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা সত্যিই ভাববার বিষয়। আল্লাহ আমাদের সেই রোজাদারদের মধ্যে শামিল না করুন, যাদের ব্যাপারে রাসূল (সা.) সতর্ক করেছেন এই বলে- ‘অনেক রোজাদার এমন আছেন, যাঁরা নিজেদের রোজা থেকে ক্ষুধা-পিপাসায় কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পান না। অনেকে রাতের নামায পড়ে থাকেন, কিন্তু তাদের নামায রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছুই দিতে পারেনা।‘ তাকওয়া ও আল্লাহ প্রেমের ধারায় সিক্ত হয়ে জীবনের প্রতি দিনকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে অতিবাহিত করার প্রেরণাই হচ্ছে সিয়াম সাধনার প্রকৃত তাৎপর্য। আর এটাই রাসূল (সা.)-এর সিয়াম পালনের মূল অনুসরণীয় দিক। আল্লাহ পাক আমাদের তাঁর অনুসরণে সঠিকভাবে রমজান পালন ও এর শিক্ষাকে জীবনে বাস্তবায়নের তৌফিক দিন। আমীন।

পর্দা

পর্দার আসল রুপঃ

. মহিলারা প্রয়োজনে ভিন্ পুরুষের সাথে কথা বলবেন কিন্তু মিহি স্বরে বলবেন না।  

আল্লাহ বলেন, ‘ওহে নবীর স্ত্রীরা তোমরা তো অন্য কোন মহিলার মতো নও, তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় কর তাহলে ( ভিন পুরুষের সাথে কথা বলার সময়) মিহি স্বরে কথা বলো না যা অন্তরে ব্যাধি আছে এমন লোককে প্রলুব্ধ করবে এবং (সর্বদা) সংগত কথা বলবে।’  (আল আহযাব:৩২ )

ইসলাম মহিলাদেরকে প্রয়োজনে ভিন পুরুষের সাথে কথা বলার অনুমতি দিয়েছে। মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ(সা:) বহু পুরুষের কাছে দ্বীনি বিষয় বর্ণনা করেছেন।

কিন্তু প্রয়োজন নেই এমন ক্ষেত্রে মহিলাদের কণ্ঠস্বর ভিন পুরুষকে শুনানো অপছন্দ করা হয়েছে। সেই জন্যই মহিলাদেরকে আযান দিতে দেয়া হয়নি। সালাতে ইমাম ভুল করলে পুরুষদেরকে আল্লাহু আকবার” কিংবা “সুবহানাল্লাহ” উচ্চারণ করে লোকমা দিতে বলা হয়েছে। কিন্তু মহিলাদেরকে বলা হয়েছে হাতের উপর হাত মেরে শব্দ সৃষ্টি করে লোকমা দিতে। উপরোক্ত আয়াতটি পর্দার বিধান সংক্রান্ত অনেকগুলো আয়াতের মধ্যে প্রথম আয়াত। এই আয়াত ও পরবর্তী  আরো কয়েকটি আয়াতে রাসুলুল্লাহ(সা) স্ত্রীদেরকে সম্বোধন করে বক্তব্য পেশ করা হয়েছে। কিন্তু লক্ষ্য হচ্ছে সকল মুসলিম পরিবারের সংশোধন। নবীর (সা) স্ত্রীদেরকে সম্বোধন করার উদ্দেশ্য হচ্ছে যখন নবীর ঘর থেকে এই পবিত্র জীবন ধারার সুচনা হবে তখন অন্য সকল মুসলিম পরিবারের মহিলারা আপনা আপনি তা অনুসরণ করতে থাকবে।  কারণ এই ঘরই তো ছিলো তাঁদের জন্য আদর্শ ঘর।”

. মহিলাদের কর্তব্য হচ্ছে গৃহাংগনেই অবস্থান করা, সাজসৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়ানো নয়।

আল্লাহ বলেন, “তোমরা তোমাদের ঘরে অবস্থান কর, পূর্বতন জাহিলিয়াতের ধাঁচে সাজ-সৌন্দর্য প্রদর্শন করে বেড়িয়োনা। সালাত কায়েম কর, যাকাত দাও এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে চল। আল্লাহ তো চান তোমাদের থেকে নবী পরিবার থেকে ময়লা দূর করতে ও তোমাদেরকে পুরোপুরি পাক-পবিত্র করতে।” ( আল আহযাব : ৩৩)

“আল্লাহ মহিলাদেরকে যেই কার্যধারা থেকে বিরত রাখতে চান তা হচ্ছে, তাদের নিজেদের সাজ-সৌন্দর্যের প্রদর্শনী করে ঘর থেকে  বের হওয়া। তিনি তাদেরকে আদেশ দেন, নিজেদের ঘরে অবস্থান কর। কারণ তোমাদের আসল কাজ রয়েছে ঘরে, বাইরে নয়। কিন্তু যদি বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন হয় তাহলে এমনভাবে বের হয়োনা যেমন জাহিলী যুগে মহিলারা বের হতো। প্রসাধন ও সাজ-সজ্জা করে সুশোভন অলংকার ও আটসাট বা হালকা মিহিন পোশাকে সজ্জিত হয়ে, চেহারা ও দেহের সৌন্দর্য উন্মুক্ত করে, গর্ব ও আড়ম্বরের সাথে চলা কোন মুসলিম সমাজের মহিলাদের কাজ নয়। এই গুলো জাহেলিয়াতের রীতিনীতি। ইসলামে এই সব চলতে পারে না।”

. কোন মহিলার কাছে কিছু চাইতে হলে পর্দার আড়াল থেকে চাইতে হবে।

“এবং যখন তাদের কাছে (নবীর স্ত্রীদের কাছে) কিছু চাইতে হয় তা চাও পর্দার আড়াল থেকে। এটি তোমাদের ও তাদের মনের জন্য পবিত্রতম পদ্ধতি।”

এই নির্দেশ আসার পর নবীর (সা) স্ত্রীদের ঘরের দরজায় পর্দা লটকিয়ে দেয়া হয় । আর যেহেতু নবীর (সা) ঘর ছিলো সকল মুসলিমের জন্য আদর্শ ঘর তাই সেই ঘরের অনুকরণে তারা নিজেদের ঘরের দরজায় পর্দা লটকিয়ে দেন।

. মহিলাদের ঘরে তাঁদের আব্বা, তাঁদের ছেলে, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, ঘনিষ্ঠ মহিলারা মালিকানাধীন ব্যক্তিরা (দাস দাসী) প্রবেশ করতে পারবে।

“তাদের আব্বা (চাচা, মামা, দাদা, দাদার আব্বা ,নানা, নানার আব্বা শামিল), তাদের ছেলে, (নাতি, নাতির ছেলে দৌহিত্র.ও দৌহিত্রের ছেলে শামিল), তাদের ভাই (বৈপিত্রেয়, বৈমাত্রেয় ও দুধ ভাই শামিল),তাদের ভাইয়ের ছেলে (তাদের নাতি ও নাতির ছেলে শামিল), তাদের বোনের ছেলে (তাদের দৌহিত্র ও দৌহিত্রের ছেলে শামিল), তাদের ঘনিষ্ঠ (মেলামেশার) মহিলারা ও তাদের মালিকানাধীন ব্যক্তিরা তাদের ঘরে প্রবেশ করলে কোন দোষ নেই । তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, অবশ্যই আল্লাহ সবকিছু প্রত্যক্ষ করেন।” (আল আহযাব: ৫৫)

. মহিলারা তাদের পরিহিত জিলবাবের (বড়ো চাদরের) একাংশ তাদের চেহারার দিকে ঝুলিয়ে দেবেন।

আল্লাহ বলেন, “ওহে নবী তোমার স্ত্রীদেরকে, মেয়েদেরকে ও মুমিন মহিলাদেরকে বলে দাও তারা যেন তাদের জিলবাবের একাংশ নিজেদের (মুখমণ্ডলের) ওপর টেনে দেয় । এতে করে তাদেরকে চেনা সহজ হবে এবং উত্যক্তও করা হবে না।” (আল আহযাব:৫৯)

এই আয়াত জিলবাব পরিধানের নির্দেশ সম্বলিত আয়াত নয় বরং পরিহিত জিলবাবের একটি অংশ ওপর থেকে ঝুলিয়ে দেবার নির্দেশ সম্বলিত আয়াত। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, এই আয়াত নাযিলের পূর্বেই মুসলিম মহিলারা জিলবাব পরা শুরু করেছেন। আর যারা জিলবাব পরতেন তারা শুধু নবীর (সা) স্ত্রীরাই ছিলেন না, সকল মহিলাই এই কাজে শামিল ছিলেন। “নিসাইল মু’মিনীন” বলে তাদেরই কথা উল্লেখ করা হয়েছে এই আয়াতে। এই আয়াত আরো প্রমাণ করে যে পূর্ববর্তী আয়াতগুলো নবীর (সা)স্ত্রীদেরকে সম্বোধন করে পর্দা সংক্রান্ত যেইসব বিধান নাযিল করা হয়েছে সেইগুলোও মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভূক্ত সকল মহিলার জন্যই প্রযোজ্য।

উল্লেখ্য যে পর্দার বিধান নাযিল হওয়ার পর মুসলিম মহিলারা জিলবাব পরিধান না করে ঘর থেকে বের হতেন না এবং জিলবাবের একাংশ দিয়ে তারা তাদের চেহারা ঢেকে পর পুরুষের দৃষ্টি থেকে হিফাযত করতেন। উম্মুল মুমিনীন আয়িশার (রাঃ) ছিলেন তাফসীরবিদ, হাদীসবিদ ও ফিকাহবিদ। আলকুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে তিনি অসাধারণ পারদর্শিতা প্রদর্শন করেছেন। ইসলামী জীবন বিধানের অনেক কিছু মুসলিম উম্মাহ তার মাধ্যমেই জানতে পেরেছে। তার সম্পর্কে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,

‘‘পুরুষদের অনেকেই কামালিয়াত অর্জন করেছে । মহিলাদের মধ্যে তা অর্জন করেছেন মারইয়াম বিনতু ইমরান ও ফিরআউনের স্ত্রী আসিয়া। আর যাবতীয় খাদ্যের ওপর যেমন সারীদের (এক প্রকার উৎকৃষ্ট ও সুস্বাদু খাদ্য) মর্যাদা, সকল নারীর ওপর তেমন মর্যাদা আয়িশার।”

আবু মূসা আল আশয়ারী (রা), (সহীহ আল বুখারী)

এই নারীশ্রেষ্ঠা আয়িশা(রা) তার পরিহিত জিলবাবের একাংশকে নিকাব বা চেহারার আবরণ বানিয়ে নিতেন।

বানুল মুস্তালিক যুদ্ধ শেষে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) মদীনায় ফেরার পথে এক মানযিলে সৈন্যদেরকে নিয়ে বিশ্রাম করেন। সেই সফরে উম্মুল মুমিনীন আয়িশা(রা) তাঁর সাথে ছিলেন। বেশ রাত থাকতেই কাফিলা সেখান থেকে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি নেয়। এই সময় আয়িশা(রা) প্রাকৃতিক প্রয়োজন সারার জন্য একটু দূরে যান। প্রয়োজন সেরে হাওদাজে ফিরে এসে দেখেন তাঁর হার গলায় নেই। হার খুঁজতে তিনি হাওদাজ ছেড়ে চলে যান। এই দিকে কাফিলা রওয়ানা হয়ে যায়। লোকেরা তাঁর হাওদাজ উটের পিঠে বসিয়ে দেয়। কিন্তু তারা টেরই পায়নি যে তিনি হাওদাজে বসা নেই। কাফিলা চলে গেলে তিনি এ স্থানে ফিরে এসে বসে পড়েন । কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ঘুমিয়ে পড়েন। সাহাবী সাফওয়ান ইবনু মুয়াত্তাল আস্সুলামী (রা) সৈন্য বাহিনীর পেছনে রয়ে গিয়েছিলেন। তিনি রাত্রি শেষে রওয়ানা হয়ে সকাল বেলা ঐ স্থানে এসে পৌঁছেন যেখানে আয়িশা (রা) ঘুমিয়ে ছিলেন। পরবর্তী ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আয়িশা (রা) বলেন, “তিনি আমাকে দেখেই চিনে ফেলেন । কারণ পর্দার বিধান প্রবর্তনের পূর্বে তিনি আমাকে দেখেছিলেন। আমাকে চিনতে পেরেই তিান বিস্মিত হয়ে উচ্চারণ করেন“ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন”। তার কণ্ঠস্বর আমার কানে যেতেই আমি জেগে উঠি ও আমার চাদর দিয়ে আমার চেহারা ঢেকে ফেলি।” (সহীহ মুসলিম, সহীহ আলবুখারী, মুসনাদে আহমদ)

. কেউ গৃহবাসীদের সম্মতি না পেয়ে তাদেরকে সালাম না জানিয়ে কারো ঘরে প্রবেশ করবেন না।

আল্লাহ বলেন, “ওহে যারা ঈমান এনেছো, নিজেদের ঘর ছাড়া অন্য কারো ঘরে গৃহবাসীদের সম্মতি না পেয়ে ও তাদেরকে সালাম না জানিয়ে প্রবেশ করোনা। এটি তোমাদের জন্য উত্তম বিধান। আশা করা যায় তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে।” (আন নূর:২৭)

. গৃহে কাউকে না পেলে বিনা অনুমতিতে অন্যের ঘরে প্রবেশ করবেন না।

আল্লাহ বলেন, “সেখানে কাউকে না পেলে বিনা অনুমতিতেই তাতে প্রবেশ করো না।” (আন্ নূর:২৮)

. গৃহবাসীদের পক্ষ থেকে যদি বলা হয়, “এখন চলে যানচলে আসতে হবে।

আল্লাহ বলেন, “আর যদি তোমাদের বলা হয় ‘এখন যান’ তাহলে ফিরে যাবে । এটি তোমাদের জন্য বিশুদ্ধ নীতি। আর তোমরা যা কিছু কর আল্লাহ্ তা ভালভাবেই জানেন।”

(আন নূর:২৮)

. লোক বসবাস করেনা এমন ঘরে কোন প্রয়োজনীয় সামগ্রী থাকলে তা আনার জন্য সেই ঘরে প্রবেশ করা যাবে

আল্লাহ বলেন“এমন ঘরে প্রবেশ করা তোমাদের জন্য দোষের নয় যেখানে কেউ বাস করে না অথচ সেখানে কোন প্রয়োজনীয় সামগ্রী রয়েছে। আর তোমরা যা কিছু প্রকাশ কর ও যা কিছু গোপন কর আল্লাহ সবই জানেন।”

১০. মুমিন পুরুষেরা তাদের দৃষ্টি সংযত রাখবেন

আল্লাহ বলেন, “ মুমিন পুরুষদের বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে ও লজ্জাস্থানের হিফাযত করে। এটি তাদের জন্য বিশুদ্ধ নীতি । তারা যা কিছু করে আল্লাহ্ তা জানেন।”  (আন্ নূর:৩০)

আপন স্ত্রী কিংবা কোন মুহাররাম মহিলাকে ছাড়া অপর কোন মহিলাকে নজর ভরে দেখা কোন পুরুষের জন্য জায়েয নয়। একবার নজর পড়া ক্ষমাযোগ্য। আবার নজর দেয়া ক্ষমাযোগ্য নয়। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা) এই ধরনের দেখাকে চোখের যিনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, “মানুষ তার ইন্দ্রিয় গুলোর মাধ্যমে যিনা করে থাকে। দেখা হচ্ছে চোখের যিনা। ফুসলানো কন্ঠের যিনা। তৃপ্তির সাথে পর নারীর কথা শুনা কানের যিনা। হাত দ্বারা স্পর্শ করা হাতের যিনা। অবৈধ উদ্দেশ্যে পথচলা পায়ের যিনা। যিনার এই সব অনুসঙ্গ পালিত হওয়ার পর লজ্জাস্থান তাকে পূর্ণতা দান করে কিংবা পূর্ণতা দান করা থেকে বিরত থাকে”। (সহীহ মুসলিম, সহীহ আল বুখারী,সুনানু আবী দাউদ)

উল্লেখ্য যে কোন কোন তাত্তি¡ক ব্যক্তি উপরি উক্ত আয়াতটিকে সামনে রেখে বলতে চান যে যদি চেহারা খোলাই না থাকে তাহলে এই আয়াতটি অর্থহীন হয়ে পড়ে। মহিলাদের খোলা রাখার অনুমতি আছে বলেই পুরুষদেরকে দৃষ্টি সংযত রাখতে বলা হয়েছে । তারা তাদের বক্তব্যকে শক্তিশালী করার জন্য বিদায় হজ্জ্বের সময়ে সংঘটিত দুইটি ঘটনাকেও তাদের পক্ষে ব্যবহার করার প্রয়াস চালান । প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে, মহিলারা তাদের চেহারা ঢেকে রাখবেন বটে, কিন্তুু তাদের চোখ তো আবরণমুক্ত থাকবে । ফলে চোখাচুখির ব্যাপার ঘটতে পারে। তদুপরি অমুসলিম মহিলারা তো তাদের চেহারা খোলাই রাখবে । অতএব দৃষ্টি সংযত রাখার নির্দেশ অবশ্যই অর্থহীন নয়। বিদায় হজ্জ্বের সময় সংঘটিত ঘটনা দুইটি এই ভাইদের বক্তব্য শক্তিশালী করে না। বরং তাদের বিরুদ্ধে বুমেরাং হয়।

প্রথম ঘটনা

“বিদায় হজের সময় নবীর (সা) চাচাতো ভাই আলফাদল ইবনুল আব্বাস (তিনি তখন একজন উঠতি-তরুণ) মাশআরুল হারাম থেকে ফেরার পথে নবীর (সা) সাথে উটের ওপর বসা ছিলেন।  পথে মহিলারা যাচ্ছিলো। আলফাদল তাদেরকে দেখতে থাকলেন। নবী (সা) তার মুখের ওপর হাত রেখে অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন।” জাবির ইবনু আবদিল্লাহ (রা), (সুনানু আবী দাউদ)

দ্বিতীয় ঘটনা

“আল খাসয়াম গোত্রের একজন মহিলা পথে রাসূলুল্লাহকে (সা) হজ্জ্ব সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন করেন । আলফাদাল ইবনুল আব্বাস (রা) এক দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকিয়ে থাকেন। নবী (সা) তার মুখ ধরে অন্য দিকে ফিরিয়ে দেন।” (সহীহ আল বুখারী, জামে আত্ তিরমিযী, সুনানু আবু দাউদ)

নবী (সা) দুইবারই উঠতি তরুণ আলফাদল ইবনুল আব্বাসের মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন, কিন্তু মহিলাদেরকে তাদের চেহারা ঢেকে নিতে বলেননি।

কারণ

এর কারণ হচ্ছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ইংগিতেই ইতোপূর্বে তিনি মহিলাদেরকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ইহরাম পরিহিত মহিলারা নিকাব পরবেন না । উপরি উক্ত ঘটনা দুইটিতে মহিলারা ছিলেন হজ্জ্বযাত্রী ও ইহরাম পরিহিতা । কাজেই আলফাদল ইবনুল আব্বাসের (রা) দৃষ্টির মুকাবিলায় তিনি তাদেরকে চেহারা ঢাকার নির্দেশ দেননি। লক্ষ্য করুন, ইহরাম পরিহিতা মহিলাদের সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, “ইহরাম পরিহিতা মহিলারা নিকাব পরবে না ও হাত মোজা পরবে না।” আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা), (সহীহ আল বুখারী)

আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন, “ইহরাম পরিহিতা মহিলারা নিকাব পরবে না ও হাত মোজা পরবে না।” আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা), (জামে আত তিরমিযী)

“ইহরাম পরিহিতা মহিলা নিকাব পরবে না ও হাত মোজা পরবে না।” আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা), (সুনানু আবী দাউদ) ।

“তিনি রাসূলুল্লাহকে (সা) ইহরাম পরিহিতা মহিলাদের হাত মোজা, নিকাব, ওয়ারাস, ও জা’ফরান রঞ্জিত পোশাক পরিধান নিষেধ করতে শুনেছেন।”

১১. মুমিন মহিলারা তাদের দৃষ্টি সংযত রাখবেন।

আল্লাহ বলেন, “মুমিন মহিলাদের বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানের হিফাযত করে।”          (আন নূর:৩১)

উল্লেখ্য যে “মহিলাদের জন্যও পুরুষদের মত দৃষ্টি সংযত রাখার বিধান দেয়া হয়েছে । তবে পুরুষদেরকে দেখার ব্যাপারে তেমন কড়াকড়ি নেই যেমন কড়াকড়ি মহিলাদেরকে দেখার ব্যাপারে পুরুষদের ওপর আরোপিত হয়েছে । এক মজলিসে মুখোমুখি বসে দেখা নিষিদ্ধ। পথ চলার সময় কিংবা দূর থেকে কোন জায়েয খেলা দেখতে গিয়ে পুরুষদের ওপর দৃষ্টি পড়া নিষিদ্ধ নয়। আর কোন যথার্থ প্রয়োজন দেখা দিলে একই বাড়িতে থাকা অবস্থায় দেখলে কোন ক্ষতি নেই। তবুও মহিলারা নিশ্চিন্তে পুরুষদেরকে দেখতে থাকবে ও তাদের সৌন্দর্য উপভোগ করতে থাকবে, এটা কোনক্রমেই জায়েজ নয়।”

১২. মহিলারা ভিন্ পুরুষের সামনে তাদের সাজসৌন্দর্য প্রকাশ করবে না। যা আপনা আপনি প্রকাশ হয়ে পড়ে তা ক্ষমাযোগ্য

আল্লাহ বলেন “তারা (মুমিন মহিলারা) যেন তাদের সাজ- সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তা ছাড়া যা আপনা আপনি প্রকাশ হয়।”(ইল্লা মা যাহারা মিন হা) আয়াতাংশের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে মত পার্থক্য রয়েছে ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে। কেউ কেউ এই আয়াতাংশের যেই জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ পেশ করেছেন তা অসাধারণ।  তিনি  বলেন, “প্রকাশ হওয়া” ও “প্রকাশ করার” মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আমরা দেখি আল কুরআন “প্রকাশ করা” থেকে বিরত রেখে “প্রকাশ হওয়ার” ব্যাপারে অবকাশ দিচ্ছে।এই অবকাশকে “প্রকাশ করা ” পর্যন্ত বিস্তৃত করা আল কুরআনের বিরোধী এবং এমন সব হাদীসেও বিরোধী যেইগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে নবীর (সা) যুগে আলহিজাবের নির্দেশ আসার পর মহিলারা (চক্ষুদ্বয় ছাড়া) চেহারা খুলে চলতেন না, আলহিজাবের হুকুমের মধ্যে চেহারার পর্দাও শামিল ছিলো এবং ইহরাম ছাড়া অন্যান্য অবস্থায় নিকাবকে মহিলাদের পোশাকের একটি অংশে পরিণত করা হয়েছিল।”

১৩. মহিলারা তাদের উড়না দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখবেন

আল্লাহ বলেন,“এবং তারা যেন তাদের উড়নার আঁচল দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখে।” (সূরা আন্ নূর: ৩১)

১৪. মহিলারা তাদের স্বামী, তাদের আব্বা, তাদের শ্বশুর, তাদের ছেলে, তাদের স্বামীর ছেলে, তাদের ভাই, তাদের ভাইয়ের ছেলে,তাদের বোনের ছেলে,তাদের ঘনিষ্ঠ স্ত্রীলোক, তাদের মালিকাধীন ব্যাক্তি,কামনাহীন অধীন পুরুষ নারীদের গোপন বিষয় বুঝে না এমন বালকের সামনে ছাড়া তাদের সাজ সৌন্দর্য প্রকাশ করবেন না

আল্লাহ্ বলেন, “তারা যেন তাদের সাজ সৌন্দর্য প্রকাশ না করে তাদের স্বামী,তাদের আব্বা,তাদের শ্বশুর,তাদের ছেলে,তাদের স্বামীর ছেলে,তাদের ভাই,তাদের ভাইয়ের ছেলে,তাদের বোনের ছেলে,তাদের ঘনিষ্ঠ স্ত্রীলোক,তাদের মালিকানাধীন ব্যক্তি, কামনাহীন অধীন পুরুষ ও নারীদের গোপন বিষয় বুঝে না এমন বালকের সম্মুখে ছাড়া।”

“এই সীমিত গণ্ডির বাইরে যারাই আছে তাদের সামনে মহিলাদের সাজ-সৌন্দর্য ইচ্ছাকৃতভাবে বা বেপরোয়াভাবে নিজেই প্রকাশ করা উচিত নয়,তবে তাদের প্রচেষ্টা সত্তে¡ও কিংবা তাদের ইচ্ছা ছাড়াই যা প্রকাশ হয়ে পড়ে কিংবা যা গোপন করা সম্ভব না হয় তা আল্ল্হার কাছে ক্ষমাযোগ্য।”

১৫. মহিলারা এমনভাবে পা মেরে চলবেন  না যাতে তাদের লুকানো সাজসৌন্দর্যের কথা লোকেরা জেনে ফেলে।

“এবং তারা যেন তাদের পা এমনভাবে না মেরে চলে যাতে তাদের লুকানো সাজ-সৌন্দর্যের কথা লোকেরা জেনে ফেলে। আর মুমিনগণ, তোমরা সকলে আল্লাহর নিকট তওবা কর । আশা করা যায় তোমরা কল্যাণ লাভ করবে।”

১৬. মালিকানাধীন ব্যক্তি নাবালেক সন্তানেরা তিনটি সময়ে অনুমতি না নিয়ে গৃহকর্তাগৃহকর্ত্রীর কক্ষে প্রবেশ করবে না।

আল্লাহ বলেন, “ওহে তোমরা যারা ঈমান এনেছো, তোমাদের মালিকানাধীন ব্যক্তি ও না-বালেক সন্তানেরা তিনটি সময়ে অনুমতি নিয়ে তোমাদের কাছে আসা উচিত : সালাতুল ফজরের আগে, দুপুরে যখন তোমরা পোশাক ছাড় ও সালাতুল ইশার পরে । এই তিনটি তোমাদের গোপণীয়তার সময়। অন্য সময় তারা তোমাদের কাছে এলে তোমাদের তাদের কোন দোষ নেই।” (আন্ নূর: ৫৮)

১৭. সন্তানেরা বালেগ হয়ে গেলে সকল সময় বড়োদের মতই অনুমতি নিয়ে আব্বাআম্মার কক্ষে প্রবেশ করতে হবে।

আল্লাহ বলেন, “আর তোমাদের সন্তানেরা যখন বালেগ হয়ে যায় তখন তাদের তেমনি অনুমতি নিয়ে তোমাদের কাছে আসা উচিত, যেমন তাদের বড়োরা অনুমতি নিয়ে আসে।” (সূরা আন-নূর:৫৯)

প্রত্যক্ষভাবে অনুমতি না চেয়ে এমন কোন সম্বোধন বা শব্দও যদি উচ্চারণ করে যার দ্বারা বুঝা যায় যে সে নিকটে আসতে চায় সেটাও অনুমতি চাওয়া বলে গণ্য হবে।প্রখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ(রা) বলেন, “তোমরা তোমাদের আম্মা ও বোনদের কাছে যাওয়ার সময়ও অনুমতি নিয়ে যাও।” (ইবনু কাসীর)।

আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদের (রা) স্ত্রী যায়নাবের (রা) বর্ণনা থেকে জানা যায় যে আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ(রা) তার ঘরে প্রবেশ করার সময়ও এমন কোন আওয়াজ করতেন যাতে বুঝা যেত যে তিনি আসছেন। হঠাৎ ঘরের মধ্যে ঢুকে যাওয়া তিনি পছন্দ করতেন না। (ইবনু জারীর)

১৮.    বৃদ্ধারা যদি সাজসৌন্দর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্য ছাড়া তাদের চাদর নামিয়ে রাখেন এতে কোন দোষ নেই। তবে বৃদ্ধারাও যদি লজ্জাশীলতা অবলম্বন করেন সেটাই তাদের জন্য উত্তম।

আল্লাহ বলেন, “আর যেই সব বৃদ্ধা বিয়ের আশা রাখে না তারা যদি সাজ-সৌন্দর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্য ছাড়া নিজেদের চাদর নামিয়ে রাখে এতে কোন দোষ নেই। তবে তারা যদি লজ্জাশীলতা অবলম্বন করেন সেটাই তাদের জন্য উত্তম।”(আননূর-৬০)

“আলকাওয়া’য়েদু মিনা ন্নিসায়ে” অর্থ হচ্ছে “বসে পড়া মহিলারা।”অর্থাৎএমন বয়সে পৌঁছে যাওয়া মহিলাগণ যেই বয়সে তাদের সন্তান জন্ম দেবার যোগ্যতা থাকে না এবং তাদেরকে দেখে পুরুষদের মধ্যেও কোন যৌন বাসনার সৃষ্টি হয় না।

এমন বৃদ্ধাদেরও সাজ -সৌন্দর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে নিজেদের চাদর নামিয়ে রাখার অনুমতি নেই। তবে সাজ-সৌন্দর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্য না থাকলে তাদের চাদর নামিয়ে রাখার অনুমতি আছে।

পর্দার বিধান

পর্দার বিধান সমাজ জীবনের পবিত্রতা নিশ্চিত করার জন্য বিজ্ঞান সম্মত বিধান। এই বিধানের তাৎপর্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে আবেগ মুক্ত মন নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা ভাবনা করা প্রয়োজন।

পর্দার বিধানের স্বরূপ নির্ণয়ে সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (রহ) প্রয়াস প্রশংসনীয়। তাঁর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ যাঁদেরকে উপলব্ধি  করে আল হিজাবের বিধান নাযিল করা হয়েছিল সেই উম্মুল মুমিনীনদের আমলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। পর্দার বিধান ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বলেন,

ক) সৌন্দর্য প্রকাশের সীমারেখা

“দৃষ্টি  সংযমের নির্দেশাবলী নারী ও পুরুষের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। আবার কতক নির্দেশ নারীদের জন্য নির্দিষ্ট । তার মধ্যে প্রথম নির্দেশ এই যে ,একটি নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে আপন সৌন্দর্য প্রদর্শন করা চলবে না। এই নিদের্শের উদ্দেশ্য ও কারণ সম্পর্কে চিন্তা করবার পূর্বে ঐ সকল নির্দেশ স্মরণ করা দরকার । মুখমন্ডল ছাড়া নারীর সারা শরীর “সতর” যা পিতা,চাচা, ভাই এবং পুত্রের নিকটও উন্মুক্ত রাখা জায়েয নয়। এটা সামনে রেখে সৌন্দর্য প্রকাশের সীমারেখা আলোচনা করা যাক।

১.      নারীকে তার সৌন্দর্য  স্বামী, পিতা, শ্বশুর, সৎপুত্র, ভাই, ভাইপো, এবং বোনের ছেলের সম্মুখে প্রকাশ করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।

২.      তাকে আপন গোলামের সম্মুখে (অন্য কারো গোলামের সম্মুখে নয়) সৌন্দর্য প্রদর্শনের অনুমতি দেয়া হয়েছে।

৩.     নারী এমন লোকের সামনেও সৌন্দর্য-শোভা সহকারে আসতে পারে যে তার অনুগত ও অধীন এবং নারীদের প্রতি তার কোন আগ্রহ-আকাঙ্খা নেই ।

৪.      যে সকল বালকের মধ্যে এখনো যৌন অনুভূতির সঞ্চার হয়নি তাদের সম্মুখেও নারী সৌন্দর্য প্রদর্শন করতে পারে।

আল কুরআনে উল্লেখ রয়েছে “(অর্থাৎ) এমন বালক যারা গোপন কথা সম্পর্কে পরিজ্ঞাত  হয়নি।

৫.      সকল সময় মেলামেশা করে এমন মেয়েদের সামনে নারীর সৌন্দর্যশোভা প্রদর্শন জায়েয আছে। আলকুরআনে ‘সাধারণ নারীগণ’ শব্দের পরিবর্তে ‘ আপন  নারীগণ’ ব্যবহার করা হয়েছে। এর দ্বারা ‘সম্ভ্রান্ত মহিলাগণ’ অথবা ‘আপন মহিলা আত্মীয়-স্বজন অথবা ‘আপন শ্রেণীর মহিলাগণ’কেই বুঝানো হয়েছে। অজ্ঞ-মূর্খ নারী’ এমন নারী যাদের চালচলন সন্দেহযুক্ত অথবা যাদের চরিত্রে কলংক ও লাম্পট্যের ছাপ আছে এই সকল নারীর সম্মুখে আলোচ্য নারীর সৌন্দর্য প্রদর্শনের অনুমতি নেই। কারণ এরাও অনাচার অমঙ্গলের কারণ হতে পারে। মুসলিমগণ সিরিয়া যাওয়ার পর মুসলিম মহিলাগণ ইয়াহুদি-খৃস্টাণ মহিলাদের সাথে মেলামেশা আরম্ভ করলে হযরত উমার (রা) সিরিয়ার গভর্নর আবু উবায়দাহ ইবনুল জাররাহকে (রা) লিখে জানালেন যাতে মুসলিম মহিলাগণকে আহলে কিতাব নারীদের সাথে হাম্মামে প্রবেশ করতে নিষেধ করা হয়। (তাফসীরে ইবনে জারীর) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) ব্যাখ্যা করেন যে, মুসলিম মহিলাগণ কাফির এবং জিম্মী নারীদের সামনে ততটুকু প্রকাশ করতে পারে যতটুকু অপরিচিত পুরুষদের সামনে প্রকাশ করতে পারে। (তাফসীরে কবীর)

কোন ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখা এসবের উদ্দেশ্য ছিলো না। বরং যে সকল নারীর স্বভাব চরিত্র ও তাহযীব-তামাদ্দুন জানা ছিলো না অথবা ইসলামের দৃষ্টিতে আপত্তিকর বলে জানা ছিলো-এই ধরনের নারীর প্রভাব থেকে মুসলিম নারীদেরকে রক্ষা করা ছিলো এসবের উদ্দেশ্য। আবার অমুসলিম নারীদের মধ্যে যারা সম্ভ্রান্ত ও লজ্জাশীল তারা আল-কুরআনের নির্দেশিত আপন মহিলাদের মধ্যে শামিল।

এই সকল সীমারেখা সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করলে দু’টো বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠে।

১.      যে সৌন্দর্য প্রকাশের অনুমতি এই সীমাবদ্ধ গণ্ডীর মধ্যে দেয়া হয়েছে তা ‘সতর-আওরতের’ আওতা বর্হির্ভুত অংগাদির। অর্থাৎ অলংকারাদি পরিধান করা,সুন্দর বেশভূষায় সজ্জিত হওয়া,সুরমা ও সুগন্ধি ব্যবহার করা এবং অন্যান্য বেশভূষা যা নারীগণ নারীসুলভ চাহিদা অনুযায়ী আপন গৃহে পড়তে অভ্যস্ত হয়।

২.      এ ধরনের বেশভূষা প্রদর্শনের অনুমতি ঐ সকল পুরুষদের সম্মুখে দেয়া হয়েছে যাদেরকে নারীদের জন্য চিরদিনের জন্য হারাম করে দেয়া হয়েছে অথবা ঐ সকল লোকের সম্মুখে যাদের মধ্যে যৌন বাসনা নেই অথবা ঐ লোকের সম্মুখে যারা কোন অনাচার অমঙ্গলের কারণ হবে না।

নারীদের বেলায় ‘আপন মহিলাগণ’ শর্ত আরোপ করা হয়েছে। অধীনদের জন্য‘যৌন বাসনাহীন’ শর্ত আরোপ করা হয়েছে । বালকদের জন্য ‘নারীদের গোপন বিষয় সম্পর্কে অপরিজ্ঞাত’ শর্ত আরোপ করা হয়েছে। এ থেকে জানতে পারা গেল যে ,শরীয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্য হচ্ছে নারীর সৌন্দর্য এমন গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাতে তার সৌন্দর্য ও বেশভূষা দ্বারা কোন প্রকার অবৈধ উত্তেজনা সৃষ্টি এবং যৌন উচ্ছৃংখলতার আশংকা হতে না পারে।

এই গণ্ডির বাইরে যত পুরুষ আছে তাদের সম্পর্কে এই আদেশ করা হয়েছে যে ,তাদের সম্মুখে সৌন্দর্য ও  বেশভূষা প্রদর্শন করা  চলবে না। উপরন্তু পথ চলার সময় এমন ভাবে পদক্ষেপ করা চলবে না যাতে গোপন সৌন্দর্য  ও বেশভূষা পদধ্বনি দ্বারা প্রকাশিত হয়ে পড়ে এবং পুরুষের দৃষ্টি উক্ত নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়। এই আদেশ দ্বারা যে সৌন্দর্য পর পুরুষ থেকে গোপন করতে বলা হয়েছে তা ঠিক তাই যা উপরে উল্লেখিত সীমাবদ্ধ গণ্ডির মধ্যে প্রকাশ করবার অনুমতি দেয়া হয়েছে। উদ্দেশ্য অতি স্পষ্ট । মহিলারা যদি বেশভূষা করে এমন লোকের সম্মুখে আসে যারা যৌন লালসা রাখে এবং মাহরাম না হওয়ার কারনে যাদের মনের যৌন লালসা পবিত্র নিষ্পাপ ভাবধারায় পরিবর্তিত হয়নি তাহলে অবশ্যম্ভাবীরুপে এর প্রতিক্রিয়া মানব সুলভ চাহিদা অনুযায়ী হবে। এটা কেউ বলে না যে , এরূপ সৌন্দর্য প্রকাশের প্রতিটি নারী চরিত্রহীন হবে এবং প্রতিটি পুরুষ কার্যত: পাপাচারী হয়ে পড়বে । কিন্তু এটাও কেউ অস্বীকার করতে পারেনা যে,সুন্দর বেশভূষা সহকারে নারীদের প্রকাশ্য চলাফেরা এবং জনসমাবেশে অংশগ্রহণ করার ফলে অসংখ্য গোপন ও প্রকাশ্য , মানসিক ও বৈষয়িক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে । আজকের ইউরোপ ও আমেরিকার নারীসমাজ নিজেদের ও স্বামীর উপার্জিত অর্থের অধিকাংশ বেশভূষায় ব্যয় করছে। তাদের এই ব্যয়ভার এত বেড়ে যাচ্ছে যে, তা বহন করার আর্থিক সংগতিও তাদের নেই। যে সকল যৌন লালসাপূর্ণ দৃষ্টি বাজারে,অফিসে ও জনসমাবেশে যোগদানকারী নারীদেরকে খোশ আমদেদ জানায় তাই কি এই উন্মাদনা সৃষ্টি করেনি? আবার চিন্তা করে দেখুন, নারীদের মাঝে সাজসজ্জার এই প্রবল আকাঙক্ষা সৃষ্টি হওয়ার ও তা বৃদ্ধি পেতে থাকার কারণ কি? এর কারণ কি এটাই নয় যে , তারা পুরুষের প্রশংসা লাভ করতে ও তাদের চোখে পছন্দনীয় হতে চায়? তা কি একেবারে নিষ্পাপ আকাংক্ষা ? এর মাঝে কি যৌন বাসনা লুকায়িত নেই যা নিজের স্বাভাবিক গণ্ডীর বাইরে বিস্তার লাভ করতে চায় এবং যার দাবী  পূরণের জন্য অপর প্রান্তেও অনুরূপ বাসনা রয়েছে? আপনি যদি এ সত্যকে অস্বীকার করেন তাহলে আগামীকাল হয়তো আপনি এটা দাবী করতে দ্বিধা করবেন না যে, যে আগ্নেœয়গিরিতে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে তার ভেতরের লাভা বাহিরে ছুটে আসতে উন্মুখ নয়। কাজ করার স্বাধীনতা আপনার আছে । যা আপনার ইচ্ছা তা করুন। কিন্তু সত্যকে অস্বীকার করবেন না। এ সত্য এখন আর গোপনও নেই। দিনের আলোর মতই এর ফল প্রকাশ হয়ে পড়েছে।এই ফল আপনি জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে গ্রহণ করছেন। কিন্তু যেখান থেকে এর প্রকাশ সুচিত হয় ইসলাম সেখান থেকেই এর প্রকাশ বন্ধ করে দিতে চায়। কারণ ইসলামের দৃষ্টিতে সৌন্দর্য প্রকাশের বাহ্যতঃ নিষ্পাপ সূচনার ওপর নিবদ্ধ নয় বরং যে ভয়ানক পরিণাম কিয়ামতের অন্ধকারের মত সমগ্র সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে তার ওপরই নিবদ্ধ।

“পর পুরুষের সম্মুখে সাজসজ্জা সহকারে বিচরণকারী নারী আলোবিহীন কিয়ামতের অন্ধকারের মত।”(জামিউত তিরমিযী)

আলকুরআনে যে পর পুরুষের সম্মুখে সৌন্দর্য প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে সেখানে একটি ব্যতিক্রমও আছে। যথা,‘ইল্লা মা জাহারা মিনহা’। এর অর্থ হচ্ছে যে সৌন্দর্য বা বেশভূষা আপনা আপনি প্রকাশ হয়ে পড়ে, তাতে কোন দোষ নেই।

লোকেরা এই ব্যতিক্রম থেকে কিছু সুবিধা লাভ করবার চেষ্টা করছে।কিন্তু আসলে এই শব্দগুলো থেকে সুবিধা লাভের কোন অবকাশ নেই। শরীয়াত প্রণেতা এই কথা বলেন যে,স্বেচ্ছায় অপরের সম্মুখে সৌন্দর্য প্রকাশ করো না । কিন্তু যে বেশভূষা আপনা আপনি প্রকাশ হয়ে পড়ে অথবা প্রকাশ হতে বাধ্য তার জন্য কেউ দায়ী হবে না । এর অর্থ অত্যন্ত পরিষ্কার। তোমার নিয়ত যেন সৌন্দর্য ও বেশভূষা প্রকাশের না হয়। তোমার মনে এই ইচ্ছা ও প্রেরণা কিছুতেই হওয়া উচিত নয় যে , নিজের সাজসজ্জা অপরকে দেখাবে কিংবা কিছু না হলেও অন্তত অলংকারাদির লুপ্ত ঝংকার শুনিয়ে তোমার প্রতি অপরের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে । তোমাকে তো আপন সৌন্দর্য-শোভা গোপন করবার যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। এরপর যদি কোন কিছু অনিচ্ছা সত্তে¡ও প্রকাশ হয়ে পড়ে এর জন্য আল্লাহ তোমাকে দায়ী করবেন না । তুমি যে বস্ত্র দ্বারা তোমার সৌন্দর্য  ঢেকে রাখবে তা তো প্রকাশ পাবেই। তোমার দেহের গঠন ও উচ্চতা, শারীরিক সৌষ্ঠব ও আকার আকৃতি তো এতে ধরা যাবে। কাজ-কর্মের জন্য আবশ্যক মতো তোমার হাত দুটো ও মুখমণ্ডলের কিয়দংশ তো উন্মুক্ত করতেই হবে। এরূপ হলে কোন দোষ নেই। তোমার ইচ্ছা তা প্রকাশ করা নয়, বাধ্য হয়েই তুমি তা করছো । এতে যদি কোন অসৎ ব্যক্তি আনন্দ-স্বাদ উপভোগ করে তো করুক। সে তার অসৎ অভিলাসের শান্তি ভোগ করবে। তামাদ্দুন ও নৈতিকতা যতখানি দায়িত্ব তোমার ওপর অর্পণ করেছিলো তুমি তা সাধ্যানুযায়ী পালন করেছো। উপরি উক্ত আয়াতের মর্ম এটাই।

তাফসীরকারগণের মধ্যে এই আয়াতের মর্ম নিয়ে যত প্রকার মতভেদ আছে তা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করলে জানতে পারা যাবে যে, যাবতীয় মত-পার্থক্য সত্তে¡ও আয়াতের মর্ম তাই দাঁড়াবে যা উপরে বলা হল। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, ইবরাহিম নাখয়ী এবং হাসান বসরীর মতে, প্রকাশ্য সৌন্দর্যের অর্থ সকল বস্ত্রাদি যার মধ্যে আভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য ঢেকে রাখা যায়; যেমন বোরকা, চাদর ইত্যাদি।

আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ আ’তা ইবনে উমার, আনাস, জাহহাক, সাঈদ, ইবনে যুবাইর, আওযায়ী এবং হানাফী মতালম্বী ইমামদের মতে এর অর্থ মুখমন্ডল ও হস্তদ্বয় এবং এতে ব্যবহৃত সৌন্দর্য উপাদান সমূহ যেমন হাতের মেহেদি, আংটি, চোখের সুরমা প্রভৃতি । সাঈদ ইবনুল মুসাইয়েবের মতে ব্যতিক্রম শুধু মুখমন্ডল এবং এক বর্ণনাতে হাসান বসরীও এই মত সমর্থন করেন। আয়িশার (রা) মতে প্রকাশ্য সৌন্দর্যের অর্থ হস্তদ্বয়,হাতের চুরি, আংটি, কংকন ইত্যাদি। তিনিও মুখমন্ডল ঢেকে রাখার পক্ষে।

মিসওয়ার ইবনে মাখরামা এবং কাতাদাহ অলংকারাদিসহ হাত খুলবার অনুমতি দেন এবং তার উক্তিতে মনে হয় যে, তিনি সমগ্র মুখমন্ডলের পরিবর্তে শুধু দুচোখ খুলে রাখা জায়েজ রাখেন। (ইবনে জারীর ও আহকামুল কুরআন)।

এই সকল মতভেদেও উদ্দেশ্য সম্পর্কে চিন্তা করে দেখুন। এই সকল মুফাসসির “ইল্লা মা জাহারা মিনহা” সম্পর্কে এটাই বলেছেন যে, আল্লাহ তায়ালা এমন সৌন্দর্য প্রকাশের অনুমতি দেন যা আবশ্যিকভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ে অথবা যা প্রকাশ করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। হাতের প্রদর্শনী অথবা একে কারো দৃষ্টির বিষয়বস্তু বানানো এদের কারো উদ্দেশ্য নয়। প্রত্যেকে আপন আপন বোধশক্তি অনুযায়ী নারীদের প্রয়োজনকে সামনে রেখে এটা বুঝবার চেষ্টা করেছেন যে ,প্রয়োজন হলে কোন বিষয়ে কতখানি পর্দার বাইরে যাওয়া যায় অথবা কোন অঙ্গ আবশ্যিকভাবে উন্মুক্ত করা যায় কিংবা স্বভাবতই উন্মুক্ত হয়। আমরা বলি যে “ইল্লা মা যাহরা মিনহা”কে এর কোন একটিতেও সীমাবদ্ধ রাখবেন না। যে মুমিন নারী আল্লাহ ও তার রাসূলের (সা) নির্দেশাবলীর অনুগত থাকতে চায় এবং অনাচার অমঙ্গলে লিপ্ত হওয়া যার ইচ্ছা নয় সে নিজেই নিজের অবস্থা ও প্রয়োজন অনুসারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে, সে মুখমন্ডল ও হস্তদ্বয় উন্মুক্ত করবে কি করবে না, করতে চাইলে কোন সময়ে করবে, কতটুকু উন্মুক্ত ও কতটুকু আবৃত রাখবে। এই ব্যাপারে ও শরীয়ত প্রণেতা কোন সুস্পষ্ট নির্দেশ দেননি। অবস্থার বিভিন্নতা ও প্রয়োজন দেখে নির্দেশ নির্ধারণ করতে হবে। যে নারী আপন প্রয়োজনে বাইরে যেতে ও কাজকর্ম করতে বাধ্য তার হাত এবং কখনো মুখমন্ডল খোলার প্রয়োজন হবে। এইরূপ নারীর জন্য প্রয়োজন অনুসারে অনুমতি রয়েছে। কিন্তু যে নারীর অবস্থা এইরূপ নয় তার বিনা কারণে স্বেচ্ছায় মুখমন্ডল ও হস্তদ্বয় অনাবৃত করা দুরস্ত নয়।

অতএব শরীয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্য এই যে, যদি নিজের সৌন্দর্য প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে কোন অংগ অংশ অনাবৃত করা হয় তাতে পাপ হবে অনি”্ছায় আপনা আপনি কিছু প্রকাশিত হয়ে পড়লে তাতে কোন পাপ হবে না। প্রকৃত প্রয়োজন যদি অনাবৃত করতে বাধ্য করে তাহলে তা জায়েজ হবে এখন প্রশ্ন এই যে, অবস্থার বিভিন্নতা হতে দৃষ্টি ফিরিয়ে শুধু মুখমন্ডল সম্পর্কে কি নির্দেশ রয়েছে? শরীয়ত প্রণেতা একে পছন্দ করেন না অপছন্দ করেন? শুধুমাত্র প্রয়োজনের সময় একে অনাবৃত করা যায়, না অপরের দৃষ্টি থেকে একে লুকিয়ে রাখার বস্তুই নয়?সূরা আহযাবের আয়াতগুলোতে এসব প্রশ্নের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।  “হে নবী, তোমার স্ত্রীগণ, কন্যাগণ এবং মুসলিম মহিলাগণকে বলে দাও তারা যেন চাদর দ্বারা নিজেদের ঘোমটা টেনে দেয়। এই ব্যবস্থার দ্বারা আশা করা যায় যে, তাদেরকে চিনতে পারা যাবে এবং তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না।”(আল আহযাব:৫৯)

বিশেষ করে মুখমন্ডল আবৃত করার নির্দেশ নিয়েই এই আয়াত নাযিল হয়েছে। “জিলবাব” শব্দের বহুবচন “জালাবীব।” এর অর্থ চাদর। ‘এদনা’ শব্দের অর্থ লটকান। “ইউদনিনা আলাইহিননা মিন আলাবিবে হিন্না”অর্থ নিজেদের ওপর চাদরের খানিক অংশ যেন লটকিয়ে দেয়। ঘোমটা দেয়ার অর্থও এটাই।কিন্তু এই আয়াতের প্রকৃত উদ্দেশ্য সাধারণভাবে পরিচিত ঘোমটা নয়। এর উদ্দেশ্য মুখমন্ডল আবৃত করণ । তা ঘোমটার দ্বারা হোক, চাদর অথবা অন্য যে কোন উপায়ে হোক । এর উপকারিতা এই বর্ননা করা হয়েছে যে, যখন মুসলিম নারী এভাবে আবৃত অবস্থায় ঘরের বাইরে যাবে ,তখন লোকেরা বুঝতে পারবে যে, এ এক সম্ভ্রান্ত মহিলা-নির্লজ্জ ও শ্লীলতা বর্জিত মহিলা নয়। এ কারনে কেউ তার শ্লীলতার প্রতিবন্ধক হবে না।

আল কুরআনের সকল মুফাসসির এই আয়াতের এই মর্মই ব্যক্ত করেছেন।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) এই আয়াতের তাফসীরে বলেন, আল্লাহ তা’আলা মুসলিম নারীদেরকে আদেশ করেছেন যে, তারা যখন প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাবে তখন যেন তারা মাথার ওপর থেকে চাদরের অংশ ঝুলিয়ে মুখমন্ডল ঢেকে নেয়।”(তাফসীরে ইবনে জারীর)

ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে শিরীন হযরত উবাইদা ইবনে সুফিয়ান ইবনে আলহারেস আলহাযরামীর নিকট জানতে চাইলেন, এই নির্দেশের ওপর কিভাবে আমল করতে হবে। এর উত্তরে তিনি নিজের ওপর চাদর  ঝুলিয়ে দেখিয়ে দিলেন। কপাল, নাক ও একটি চোখ ঢেকে ফেললেন। শুধু একটি চোখ অনাবৃত রাখলেন। (তাফসীরে ইবনে জারির)

আল্লামা ইবনে জারীর তাবারী এই আয়াতের তাফসীরে লিখেন, ‘হে নবী, আপনার  স্ত্রীগণ, কন্যাগণ ও মুসলিম মহিলাগণ কে বলে দিন, যখন কোন প্রয়োজনে আপন ঘর থেকে বাইরে যায় তখন যেন ক্রীতদাসীদের পোশাক না পরে- যে পোশাকে মাথা ও মুখমন্ডল অনাবৃত থাকে এবং তারা যেন নিজেদের ওপরে চাদরের ঘোমটা টানিয়ে দেয় যাতে ফাসিক লোকেরা তাদের শীতল অন্তরায় না হয় এবং জানতে পারে এরা সম্ভ্রান্ত মহিলা।’ (তাফসীরে ইবনে জারীর)

আল্লামা আবু বকর জাসসাস বলেন, “এই আয়াতের দ্বারা এই কথা প্রমাণিত হয় যে, যুবতী নারীকে পরপুরুষ হতে তার মুখমন্ডল আবৃত রাখার আদেশ করা হয়েছে এবং ঘর থেকে বাইরে যাবার সময় পর্দা পালন ও সম্ভ্রমশীলতা প্রদর্শন করা উচিত যাতে অসৎ অভিপ্রায় পোষণকারী তার প্রতি প্রলুব্ধ হতে না পারে।” (আহকামুল কুরআন)

আল্লামা নিশাপুরী তাঁর  ‘তাফসীরে গারায়েবুল কুরআনে’ লিখেন, “ইসলামের প্রাথমিক যুগে মেয়েরা জাহিলিয়াত যুগের মতো কামিজ ও দোপাট্টা পরে বাইরে যেতো । সম্ভ্রান্ত মহিলাদের পোশাকও নিম্নশ্রেণীর মেয়েদের পোশাক থেকে পৃথক ছিলোনা। অতঃপর আদেশ হলো যে, তারা যেন চাদর টেনে তাদের মুখমন্ডল ঢেকে ফেলে যাতে লোকেরা মনে করতে পারে যে, এরা সম্ভ্রান্ত মহিলা, অশ্লীলতা বর্জিত মহিলা।” ইমাম রাজী লিখেন, “জাহিলিয়াত যুগে সম্ভ্রান্ত মহিলাগণ এবং কৃতদাসীগণ বেপর্দা চলাফেরা করতো এবং অসৎ লোক তাদের পিছু নিতো। আল্লাহ তা’আলা সম্ভ্রান্ত নারীদের প্রতি আদেশ করলেন তারা যেন চাদর দ্বারা নিজেদেরকে আবৃত করে। ‘যালিকা আদনা আঁইউরাফনা ফালা ইউযাইনা”-আয়াতাংশের দু’প্রকার মর্ম হতে পারে। এক. এই পোশাক থেকে বুঝা যাবে যে, এরা সম্ভান্ত মহিলা এবং এদের পিছু নেয়া হবে না। দুই .এর দ্বারা বুঝা যাবে যে,এরা চরিত্রহীনা নয়। কারণ যে নারী তার মুখমন্ডল ঢেকে রাখে তার কাছ থেকে কেউ এ আশা পোষণ করতে পারে না যে, সে আওরত (শরীরের যে অংশ স্বামী-স্ত্রী ছাড়া সকলের নিকট আবৃত রাখতে হয়) অনাবৃত করতে রাজী হবে। এই পোশাক এটাই প্রমাণ করবে যে,সে একজন পর্দানশীন নারী এবং তার দ্বারা কোন অসৎ কাজের আশা করা বৃথা।”(তাফসীরে কবীর)

কাযী বায়জাবী লিখেন, “ইউদনীনা আলাইহিন্না মিন জালাবীবে হিন্না’-র অর্থ এই যে, যখন তারা আপন প্রয়োজনে বাইরে যাবে তখন চাদর দ্বারা একাংশ ও মুখমন্ডল ঢেকে নেবে। এখানে ‘মিন’ শব্দটি ‘তাব’য়ীদ’- এর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে।অর্থাৎ চাদরের একাংশ দিয়ে মুখমন্ডল আবৃত করতে হবে একাংশ শরীরের ওপর জড়িয়ে দিতে হবে। ‘যালিকা আদনা আইউরাফনা’ দ্বারা সম্ভ্রান্ত নারী।এবং ক্রীতদাসী ও গায়িকাদের মধ্যে পার্থক্য করা হয়েছে। “ফালা ইউযাইনা’’ দ্বারা বুঝানো হয়েছে’ সন্দেহভাজন লোক তাদের শ্লীলতাহানির দুঃসাহস করবে না।”(তাফসীরে বায়জাবী)

এ সকল উক্তি থেকে প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কিরামের(রাঃ) পবিত্র যুগ থেকে শুরু করে অষ্টম শতব্দী পর্যন্ত প্রত্যেক যুগে উক্ত আয়াতের একই মর্ম করা হয়েছে। হাদীসগুলোর প্রতি লক্ষ্য করলে তা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর নবী করীমের (সা) যুগে সাধারণভাবে মুসলিম নারীগণ মুখমন্ডলের ওপর আবরণ দেয়া শুরু করেন এবং অনাবৃত মুখমন্ডল নিয়ে চলাফেরার প্রচলন বন্ধ হয়ে যায়।

সুনানু আবী দাউদ, জামিউত তিরমিযী, মুয়াত্তা ইমাম মালিক ও অন্যান্য হাদীস গ্রন্থগুলিতে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) ইহরাম অবস্থায় মহিলাদের মুখে আবরণ এবং হাতে দস্তানা পরিধান করা নিষেধ করে দিয়েছেন । এতে প্রমাণিত হয় যে সেই পবিত্র যুগেই  মুখমন্ডল আবৃত করার জন্য আবরণ এবং হস্তদ্বয় ঢাকবার জন্য দস্তানা ব্যবহারের প্রচলন ছিলো। শুধু ইহরামের অবস্থায় তা ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছিলো। কিন্তু হজ্জের সময় নারীর মুখমন্ডল জনসাধারণের দৃষ্টিগোচর করা এর উদ্দেশ্য ছিলো না। এর উদ্দেশ্য ছিলো, ইহরামের দীনবেশে মুখের আবরণ যেন নারীদের পোশাকের কোন অংশবিশেষ না হতে পারে যা অন্য সময়ে সাধারণভাবে হয়ে থাকে।

অন্যান্য হাদীসে রয়েছে যে, ইহরাম অবস্থায়ও নবীর (সা) স্ত্রীগণ ও অন্যান্য মুসলিম মহিলাগণ আবরণহীন  মুখমন্ডল পর-পুরুষের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখতেন।হযরত আয়িশা (রা)বলেন, “যানবাহন আমাদের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলো এবং আমরা রাসূলুল্লাহর(সা) সংগে ইহরাম অবস্থায় ছিলাম।যখন লোক আমাদের সম্মুখে আসতো, আমরা আমাদের চাদর মাথার ওপর থেকে  মুখমন্ডলের ওপর টেনে দিতাম।তারা চলে গেলে আবার মুখমন্ডল খুলে দিতাম।” (সুনানু আবী দাউদ)

ফাতিমা বিনতে মানযার বলেন, “আমরা ইহরাম অবস্থায় কাপড় দিয়ে মুখমন্ডল ঢেকে রাখতাম। আমাদের সাথে আসমা বিনতে আবু বকরও ছিলেন।

“কিতাবুল হজ্জ্বে হযরত আয়িশার (রা) এই উক্তি উদ্বৃত রয়েছে: “নারীগণ যেন ইহরাম অবস্থায় নিজেদের চাদর মাথা থেকে মুখমন্ডলের ওপর ঝুলিয়ে দেয়।”

“আলকুরআনের সংশ্লিষ্ট শব্দাবলী ও জনসাধারণ্যে তার স্বীকৃতি, সর্বসম্মত তাফসীর এবং রাসূলুল্লাহর (সা) যুগে তার বাস্তবায়নের দিকে যে ব্যক্তি  লক্ষ্য করবে তার পক্ষে এ সত্যকে অস্বীকার করা সম্ভব হবে না যে, ইসলামী শরীয়তে পর-পুরুষের সামনে নারীদের মুখমন্ডল ঢেকে রাখার নির্দেশ রয়েছে এবং স্বয়ং  রাসূলুল্লাহর (সা) যুগেই এ নির্দেশ প্রতিপালিত হয়েছে। যে পবিত্র ব্যক্তিত্বের প্রতি আলকুরআন নাযিল হয়েছিলো তাঁর চোখের সামনেই মুসলিম মহিলাগণ একে বাহিরের পোশাকের অংশ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন এবং সেকালেও এর নাম ছিলো ‘নিকাব’ বা আবরণ।”

“ইল্লামা যাহারা মিনহা” আয়াতাংশের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মত-পার্থক্য রয়েছে ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে। কেউ কেউ এই আয়াতাংশের চেহারা খোলা রাখার অনুমতি রয়েছে বলে মনে করেন। কিন্তু সুক্ষ্নদর্শী ইসলামী চিন্তাবিদ সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (রহ) এই আয়াতাংশের যেই জ্ঞানগর্ভ বিশ্লেষণ পেশ করেছেন তা অসাধারণ। তিনি বলেন, “প্রকাশ হওয়া” এবং “প্রকাশ করার” মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আমরা দেখি আলকুরআন “প্রকাশ করা” থেকে বিরত রেখে “প্রকাশ হওয়া”-র ব্যাপারে অবকাশ দিচ্ছে। এই অবকাশকে “প্রকাশ করা” পর্যন্ত বিস্তৃত করা আল কুরআনের বিরোধী এবং এমন সব হাদীসেরও বিরোধী যেগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে নবীর (সা) যুগে আলহিজাবের নির্দেশ আসার পর মহিলারা (চক্ষু ছাড়া) চেহারা খুলে চলতেন না, আলহিজাবের হুকুমের মধ্যে চেহারার পর্দা ও ছিলো এবং ইহরাম ছাড়া অন্যান্য অবস্থায় নিকাবকে মহিলাদেরকে পোশাকের একটি অংশে পরিণত করা হয়েছিলো।”

[উৎস: এ কে এম নাজির আহমেদ রচিত

“পর্দার আসল রূপ” গ্রন্থ ও তাঁর “মাওলানা মওদূদী” গ্রন্থের পর্দার বিধান অংশটি সংকলন করা হয়েছে]