জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০

Posted in জরুরী তথ্য on December 23, 2014 by

পূর্বকথা

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর এক ঐতিহাসিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশি জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করি। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের জনগণকে স্বাধীনচেতা ও দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরের মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখে ড. মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে গঠন করা হয় বাংলাদেশ জাতীয় শিক্ষা কমিশন। এরপর সময়ের ক্রমপরম্পরায় বিভিন্ন সময়ে আরো নয়টি শিক্ষা কমিশন/কমিটি/টাস্কফোর্স গঠিত হয়। সর্বশেষ বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ৬ এপ্রিল জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ২০০৯ গঠন করে। গত ৭ সেপ্টেম্বর ২০০৯ এ কমিটি তাদের চূড়ান্ত খসড়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট পেশ করে।

স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ ৩৯ বছরে আমরা সর্বমোট ১০টি শিক্ষা কমিশন/শিক্ষা সংস্কার কমিটি/অন্তর্বর্তীকালীন টাস্কফোর্স/শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির বিশাল বিশাল রিপোর্ট পেয়েছি। এ সকল কমিশন/কমিটির রিপোর্টে প্রদত্ত সুপারিশমালা পর্যালোচনা করে আমরা এ কথা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, সামগ্রিকভাবে এসব কমিশন/কমিটি তাদের প্রতিবেদনে ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেয়া শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন বাংলাদেশি জাতির শিক্ষার ভিত্তি নির্ধারণ তথা পূর্ণাঙ্গ শিক্ষানীতি প্রণয়নের পরিবর্তে শিক্ষার কাঠামোগত বিন্যাস, গুণগত ও পরিমাণগত উন্নয়নের জন্য সুপারিশ প্রণয়নের উপর তাদের পূর্ণ প্রচেষ্টা বিনিয়োগ করেছে। অধিকন্তু এসব কমিশন/কমিটির সুপারিশমালার অধিকাংশই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। তাই আঙ্গিক দিক থেকে আমরা উপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পেলেও আমাদের মনন ও মানসজগতকে ঔপনিবেশিকতার যাঁতাকল ও নব্য সাম্রাজ্যবাদী/নব্য উপনিবেশবাদীদের কবল থেকে মুক্ত করতে পারিনি। অক্টোবর-০৯, শিক্ষানীতির খসড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় এবং তা নিয়ে সারাদেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভের ঝড় ওঠে। এ বছর ৩১ মে ২০১০, মন্ত্রীসভায় জাতীয় শিক্ষানীতির চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুমোদন করা হয়। এরপর থেকেই সকলে গভীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিলেন শিক্ষানীতিতে কি কি পরিবর্তন করা হয়েছে তা জানার জন্য। কিন্ত মে মাসে শিক্ষানীতির চূড়ান্ত প্রতিবেদন অনুমোদন করা হলেও চার মাসে তা প্রকাশ না করায় বিভিন্ন মহল থেকে সন্দেহ করা হতে থাকে সরকার হয়তো গোপনে শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করবে। অবশেষে গত ৩ অক্টোবর-২০১০, জাতীয় সংসদে শিক্ষানীতির চূড়ান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর সর্বসাধারণের জন্য সেটি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এ শিক্ষানীতির চূড়ান্ত প্রতিবেদন নিয়ে দেখা দিয়েছে বিভ্রান্তি। পুরো বিষয়টি অন্ধকারে ছেড়ে দেয়ার মত। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে পাঠ্যসূচি অধ্যায়ের নম্বর বন্টন অধ্যায়টি রাখা হয়নি। ফলে খসড়া শিক্ষানীতির সাথে চূড়ান্ত শিক্ষানীতির সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য কেউ খুঁজে বের করতে পারছেন না। এ শিক্ষানীতির এমন অনেক বিষয় যা অসংগতিপূর্ণ ও পরস্পর বিরোধী । তা ছাড়া এ শিক্ষানীতি গতানুগতিক ও নৈতিক দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ।

 


 

সারসংক্ষেপ

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন হওয়ার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট www.moedu.gov.bd -তে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে এবং এ শিক্ষানীতির আলোকেই আগামী দিনের শিক্ষা কার্যক্রম ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। জাতীয় শিক্ষানীতির-২০১০ পর্যালোচনা করার পর এর যে সারসংক্ষেপ দাঁড়ায় তা নিম্নরূপ:

• জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর চূড়ান্ত খসড়ায় শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, “মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়নে ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা।পাশাপাশি শিক্ষার মাধ্যমেই জাতিকে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার বৈশিষ্ট্য ও দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এই শিক্ষানীতি সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী দেশে গণমুখী, সুলভ, সার্বজনীন, সুপরিকল্পিত এবং মানসম্পন্ন শিক্ষাদানে সক্ষম শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার ভিত্তি ও রণকৌশল হিসেবে কাজ করবে।”

• শিক্ষার কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস করে প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত এবং মাধ্যমিক শিক্ষা নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে; উচ্চ শিক্ষার কাঠামো অপরিবর্তিত রয়েছে।

• সাধারণ ও মাদরাসা শিক্ষা উভয় ধারাতেই প্রাথমিক স্তর হবে বাধ্যতামূলক মৌলিক শিক্ষার স্তর এবং এতে অভিন্ন পাঠ্যসূচি অনুসৃত হবে। তবে মাদরাসার ক্ষেত্রে কুরআন, হাদীস, আরবি এসব বিষয় অতিরিক্ত পড়তে হবে।

• প্রাথমিক স্তরে শিশুদের শিখনকার্যে আগ্রহ সৃষ্টির জন্য ১ বছরের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা এবং এর জন্য অবকাঠামোগত সুযোগ সৃষ্টির সুপারিশ করা হয়েছে।

• প্রাথমিক স্তরে সাধারণ ও মাদরাসা শিক্ষা উভয় ধারাতেই ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলেও মাধ্যমিক স্তরের সাধারণ শিক্ষাধারার মানবিক শাখা ও ভোকেশনাল শিক্ষায় ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে; কিন্তু বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার পাঠ্যক্রম থেকে তা পুরোপুরি বাদ দেয়া হয়েছে।

• মাধ্যমিক স্তরের সাধারণ শিক্ষাধারায় তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলেও মাদরাসা শিক্ষাধারায় তা ঐচ্ছিক হিসেবে রাখা হয়েছে এবং প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষা-উপকরণ (Teaching aid) হিসেবে কম্পিউটার ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।

• তৃতীয় থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত সাধারণ ও মাদরাসা শিক্ষা উভয় ধারাতেই বাংলাদেশ স্টাডিজ নামে সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে; কিন্তু মাদরাসা শিক্ষার নবম-দশম শ্রেণীতে একে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে। শিক্ষানীতির কোথাও এর পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু (Content) সম্পর্কে কোনো নির্দেশনা নেই। এছাড়া প্রাথমিক স্তরে ৩য় থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনসহ পরিবেশ নামের একটি বিষয় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

• প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর শেষে পাবলিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্তরভিত্তিক পারদর্শিতার মূল্যায়ন করা হবে। এর উপর ভিত্তি করে সনদ প্রদান করা হবে। এর মধ্যবর্তী সময়ের জন্য পঞ্চম ও দশম শ্রেণী শেষে আঞ্চলিক পর্যায়ে অভিন্ন প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে মূল্যায়নের কথা বলা হয়েছে।

• মাদ্রাসা শিক্ষাধারার শিক্ষাক্রমে পূর্বের সাধারণ ও বিজ্ঞান শাখার পাশাপাশি ব্যবসায় শিক্ষা শাখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে; কিন্তু হিফজুল কুরআন ও মুজাব্বিদ মাহির শাখা বাতিল করা হয়েছে।

• সাধারণ শিক্ষাধারায় প্রাথমিক স্তর থেকেই ললিতকলা শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

• ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাকে বিদেশী ধারার কারণে বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করে কোনো রূপ সংস্কারপ্রস্তাব ও নিরীক্ষা কার্যক্রমের আওতার বাইরে রেখে পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য দেয়া হয়েছে।

• মাদরাসা শিক্ষাধারার এ যাবতকাল পর্যন্ত চলমান স্বাতন্ত্র্যকে সমতায়ন (homogenization) -এর যুক্তিতে বহুলাংশে সংকুচিত করে নিয়ে আসা হয়েছে।

• বর্তমান মাদরাসা শিক্ষার ক্বাওমি ও আলিয়া এ দুটোকে পৃথক দেখানো হয়েছে এবং কওমী মাদ্রাসার জন্য আলাদা কওমী মদ্রাসা শিক্ষা কমিশন করার কথা বলা হয়েছে।

• শিক্ষানীতি সম্পর্কে এতটুকু বলা যায় শিক্ষানীতি-২০১০, মূলত একটি স্তরগত পরিবর্তনশীল শিক্ষানীতি। শিক্ষাব্যাবস্থার গুনগত বৈশিষ্ট ও মৌলিক নীতি সংক্রান্ত উন্নত দর্শন এ ব্যাবস্থায় স্থান পায়নি। দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠির চিন্তা ও বিশ্বাসের পুরোপুরি প্রতিফলন এতে হয়নি। এমনকি কাঠামোগত দিকেও খসড়া শিক্ষানীতির ন্যায় পাঠ্যসূচি মান বন্টন সংক্রান্ত সংযোজনীগুলো স্থাপন না করায় এ দিকটাও অসম্পুর্ণ থেকে যায়। এসব কারনে শিক্ষানীতির পুর্নাঙ্গতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

খসড়া শিক্ষানীতি ‘০৯ থেকে জাতীয় শিক্ষানীতি ‘১০ কিছু পর্যবেক্ষণ

২০০৯ সালের যে খসড়া শিক্ষানীতি প্রকাশ করা হয় তার মূল বিষয় ছিল সংযোজনী ২ও৩ নামের অধ্যায়টি। প্রথম শ্রেণী থেকে এইচএসসি/ আলীম পর্যন্ত বিভিন্ন শ্রেণীতে কোন বিষয়ে কত নম্বরের কোর্স পড়ানো হবে তার বিস্তারিত উল্লেখ ছিল এই অধ্যায়ে। ফলে এই অধ্যায়ের মাধ্যমে শিক্ষানীতির মূল চরিত্র প্রকাশ পায় এবং সকল শ্রেণীর সাধারণ মানুষ শিক্ষানীতির বৈশিষ্ট্য বুঝতে সক্ষম হয়। এই অধ্যায়ের উপর ভিত্তি করেই সারাদেশের শিক্ষানীতি নিয়ে প্রবল প্রতিবাদ গড়ে ওঠে। কিন্তু চূড়ান্ত শিক্ষানীতি থেকে এই অধ্যায়টি বাদ দেওয়ায় খসড়া শিক্ষানীতির সাথে চূড়ান্ত শিক্ষানীতির তুলনার কোন সুযোগ পাচ্ছে না। খসড়া শিক্ষানীতির সাথে চূড়ান্ত শিক্ষানীতির কতটুকু সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য রয়েছে এবং খসড়া শিক্ষানীতির যেসব বিষয় নিয়ে সারাদেশে প্রবল আপত্তি উঠেছিল তার কতটুকু রাখা বা বাদ দেয়া হয়েছে তা মিলিয়ে দেখার কোন সুযোগ রইল না।

খসড়া শিক্ষানীতিতে অনেকগুলো আপত্তিকর বিষয় থাকলেও মূলত তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে খসড়া শিক্ষানীতি নিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। এই তিনটি প্রধানতম বিষয়গুলো হল, (ক) শিক্ষানীতির শুরুতে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অধ্যায়ে সেকুল্যার শব্দের প্রয়োগ, (খ) সাধারণ শিক্ষায় নবম ও দশম শ্রেণী থেকে বাধ্যতামূলক ধর্মশিক্ষা উঠিয়ে দেয়া (গ) মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্যসূচি থেকে কুরআন-হাদীস আর ইসলামী শিক্ষা ব্যাপকভাবে কাটছাট করা। এই তিনটি বিষয় ছিল মারাত্মক ভাবে আপত্তিকর। বাংলাদেশের মত শতকারা ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশের জাতীয় শিক্ষানীতির দর্শন এভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী মূলত তাদের ধর্মীয় পরিচয় হারাবে এবং তারা তথাকথিত সেকুল্যার জাতির অভিশপ্ত জীবনে প্রবেশ করবে। তাই এই দর্শন এদেশের সর্বস্তরের মুসলিম জনগোষ্ঠী প্রত্যাখান করেছিল। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে সেকুল্যার শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছে যেটি ইতবাক কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্যসূচির ব্যাপারে আপত্তি উত্থাপন করে যেসব বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল তা কতটুকু শিক্ষানীতিতে রাখা হয়েছে বা আপত্তিকর বিষয়ে শিক্ষানীতিতে কতটুকু সংশোধন করা হয়েছে সে বিষয়ে তুলনার কেউ সুযোগ পাচ্ছে না। কারণ চূড়ান্ত প্রতিবেদনে পাঠ্যসূচির সেই নম্বর বন্টন অধ্যায়টি নেই।

অতীতে সকল শিক্ষানীতিতে মান বন্টন অধ্যায় ছিল

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে তিনটি শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এগুলো হল কুদরাত-এ-খুদা কমিশন- ১৯৭২, মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশন- ১৯৮৮ এবং জাতীয় শিক্ষা কমিশন- ২০০৩ (মনিরুজ্জামান মিঞা শিক্ষা কমিশন)। এছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কার কমিটি ১৯৮৯, জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি ১৯৯৭ (শামসুল হক শিক্ষানীতি), জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০০, ড. এম এ বারী কমিশন ২০০২ এবং সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। প্রত্যেকটি শিক্ষানীতির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল পাঠ্যসূচি এবং মানবন্টন। কোন কোন প্রতিবেদনে কোন বিষয়ে কতটি ক্লাস হবে সে বিষয়ও উল্লেখ ছিল। কিন্তু সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর প্রতিবেদনে পাঠ্যসূচি অধ্যায়ে মানবন্টন বিষয়ের উল্লেখ নেই।

বর্তমান শিক্ষানীতি ও খুদা কমিশন এক এবং অভিন্ন পথের যাত্রী

স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ শাসনামলে একটি শিক্ষা কমিশন এবং তিনটি শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে। ১৯৭৪ সালে বিজ্ঞানী কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে প্রণীত হয় কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন। এরপর ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর শামসুল হকের নেতৃত্বে “জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি” ২০০০ সালে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’ এবং বর্তমানে প্রফেসর কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ এর চূড়ান্ত খসড়া প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। খুদা কমিশনের পর যে তিনটি শিক্ষানীতি আওয়ামীলীগ প্রণয়ন করেছে তার প্রত্যেকটি প্রণয়ন করা হয়েছে খুদা কমিশনকে ভিত্তি করেই। খুদা কমিশনকে কিভাবে যুগোপযোগী করে বাস্তবায়ন করা যায় সেটিই ছিল এ তিনটি শিক্ষানীতি কমিশন প্রণয়নের মূল লক্ষ্য। ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর শামসুল হকের নেতৃত্বে যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয় তা ছিল আসলে খুদা কমিশনেরই আধুনিক ভার্সন। আর সর্বশেষ যে শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন করা হয়েছে তা করা হয়েছে “৯৭” সালের শিক্ষানীতিকে ভিত্তি করে যার মূল ভিত্তি ছিল খুদা কমিশন। যে কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে বর্তমান শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়েছে তিনি ১৯৭৪ সালে কুদরাত-এ-খুদা কমিশনেরও সদস্য ছিলেন। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই তারা চেয়েছে খুদা কমিশন বাস্তবায়ন করতে। সেজন্য তারা সবসময় সেটিকে সময়োপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় বসার পরপরই শিক্ষামন্ত্রী নূরূল ইসলাম নাহিদ ২০০৯ সালের ২৮ জানুয়ারী একটি অনুষ্ঠানে ঘোষণা দেন, কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের আলোকে প্রণীত শামসুল হক শিক্ষানীতিকে যুগোপযোগী করে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হবে। আর খুদা কমিশন নিয়ে প্রতিবাদের মূল বিষয় ছিল ধর্মশিক্ষাকে অবহেলা করা। আর পরের শিক্ষানীতি যেহেতু খুদা কমিশনকে কেন্দ্র করে করা হয়েছে তাই সেক্ষেত্রে ধর্মকে গুরুত্বহীন করার বিষয়টি স্থান পেয়েছে ঘুরে ফিরে এবং আওয়ামী লীগ আমলে প্রণীত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এ ধর্ম। সর্বশেষ শিক্ষানীতির ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।

এ শিক্ষানীতি ইঁদুর বিড়াল সাদৃশ্য

জাতীয় শিক্ষানীতি চুড়ান্ত করার লক্ষ্যে জনগনের পরামর্শ ও মতামতের নিমিত্তে যে খসড়া শিক্ষানীতি ২০০৯ চুড়ান্ত করা হয়েছিল মূলত এই শিক্ষানীতি ছিল শিক্ষার অবকাঠামোগত সংস্কারের ভিত্তি। যেখানে চিন্তা, চেতনা ও বিশ্বাসে সেক্যুলারপন্থী বানানোর নব কৌশল ইংরেজ আমলের প্রণীত শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক চরিত্র ফুটে উঠে। স্বাধীন বাংলাদেশ এবং দেশের মানুষের বিশ্বাস ও চিন্তাকে কেন্দ্রকরে এ শিক্ষানীতির দর্শন গড়ে উঠেনি। এটি জাতীয় শিক্ষানীতির একটি মৌলিক গলদ। অধিকন্তু চুড়ান্ত খসড়ায় পাঠ্যক্রম সংযোজনীর মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার মূল চরিত্র সম্পর্কে যতটুকুন অবগত হওয়ার সুযোগ ছিল শিক্ষানীতি-২০১০ প্রনয়নের সময় সেটি ও প্রকাশ না করে শিক্ষানীতির মৌলিকত্ব যতটুকু ছিল তাও নষ্ট করা হয়েছে। মূলত শিক্ষানীতি নিয়ে এ ইঁদুর বিড়াল সাদৃশ্য কাজটি কেন করা হলো, এটি একটি বড় রহস্য। সুতরাং রহস্যপূর্ণ, অস্পষ্ট কোন শিক্ষানীতি জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির সোপান হতে পারেনা।

ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের অন্তরালে ধর্মবিমুখ নতুন প্রজন্ম তৈরী করাই মূল লক্ষ্য

ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism)-র সংজ্ঞা

ধর্মনিরপেক্ষতা ইংরেজী (Secularism)-র বাংলা প্রতিশব্দ। Secularism) রাষ্ট্র দর্শনের অপর নাম Secularism. Secular অর্থ ইহলৌকিক, পার্থিব পরকাল বিমুখতা ইত্যাদি।

“র্যানডম হাউজ অব দ্যা ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ”-এ Secular বা ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “যা ধর্ম সম্পর্কিত নয় (Not perlaining toor connceted with religious order)| আর ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে এটি একটি রাজনৈতিক বা সামাজিক দর্শন যা সকল ধর্মবিশ্বাসকে নাকচ করে দেয় (Rejects all forms of religious faith)| Encyclopedia of Britanica-র সংজ্ঞা ও অনুরূপ। অর্থ্যাৎ যারা কেনো ধর্মের সংগে সম্পৃক্ত নন, কোনো ধর্মের অনুসারী নন, কোনো ধর্মে বিশ্বাসী নন এবং আধ্যাত্মিকতা ও পবিত্রতার বিরোধী তাদেরকেই বলা হয় ধর্মনিরপেক্ষ। চেম্বারস ডিকশনারির মতে, ‘Education should be independent of religion” অর্থ্যাৎ ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ হচ্ছে এমন এক বিশ্বাস যার রাষ্ট্রনৈতিক শিক্ষা ইত্যাদি ধর্মমুক্ত থাকবে।

Oxford Dictionary-‡Z Secularism means the doctrine that morality should by besed sotely of regard to the wellbeing of mankind in the present life be exclusion of all consideration draw from belief in good or in future state.

অর্থ্যাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা এমন এক মতবাদ যা মনে করে আল্লাহ বিশ্বাস, পরকাল বিশ্বাস বিবেচনা থেকে মুক্ত থেকে মানবজাতির বর্তমান কল্যাণ চিন্তার উপর ভিত্তি করে নৈতিকতা গড়ে উঠবে।

প্রাচ্যবিদ ড. স্মিথ এর মতে The secular state is a state which guarantees of religion, deals with individuals as citizen irrest active of his religion is not constitutionally corrected to a particular religion nor does it seek either to promote or intyer fere with religion”

অর্থ্যাৎ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বলতে বুঝায় এমন এক রাষ্ট্র যা ধর্মীয় স্বাধীনতা দান করে ব্যক্তিকে ধর্ম নির্বিশেষে নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করে এবং শাসনতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্রে কোনো ধর্মের সাথে সংযুক্ত থাকেনা- ধর্মের উন্নতিও চায় না, হস্তক্ষেপও করেনা। বস্তুত Secularism বলতে বুঝায় এমন মতবাদ, যা পারলৌকিক ধ্যানধারণা ও ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীনভাবে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলে। রাষ্ট্রের নীতি ও পরিচালনায় কোনোভাবেই ধর্মকে বিবেচনা করে না মুসলিম বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ইসলামমুক্ত শাসন। ইসলামকে ব্যক্তির জীবনে সীমাবদ্ধ রেখে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করা। ইসলাম থেকে রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পূর্ণভাবে পৃথক করা।

ধর্মনিরপেক্ষতার উৎপত্তি কোথায়

চার্চ ও রাষ্ট্রের দ্বন্দ-সংঘাতের মাধ্যমে ইউরোপে প্রথম Secularism রাষ্ট্র দর্শনের প্রসার ঘটে। কয়েক শতাব্দী ব্যাপী বিভিন্ন দার্শনিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় কার্যকলাপের ফলশ্রুতিতে ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ পূর্ণতা লাভ করে। এর বিকাশে সহায়তা করছে ইউরোপীয় রেনেসাঁ, শিল্প বিপ্লব, জাতীয়তাবাদের আবির্ভাব, ফরাসী বিপ্লব এবং বিভিন্ন দার্শনিকের (যেমন- ম্যাকিয়াভেলি, থমাস, হবস, জর্জ জের, মার্ক্স এঙ্গেলস, ভলটেয়ার প্রমুখ) নাস্তিক্য, বস্তুবাদী, সমাজতান্ত্রিক ইত্যাদি চিন্তাধারা।

মুসলিম বিশ্বেও রাজনীতি বরাবরই ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন কারণে ক্রমান্বয়ে রাষ্ট্র ও ইসলামের বন্ধন দুর্বল হতে থাকে। তবুও অনেক বিচ্যুতি সত্ত্বেও আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি ছিল আল-ইসলাম। কিন্তু পশ্চিমা ঊপনিবেশিক শাসনের বিস্তার ও অভ্যন্তরীণ অবক্ষয়ের কারণে মুসলিম বিশ্বে Secularism ভাবধারার প্রসার ঘটে। মোস্তফা কামাল-এর নেতৃত্বে Secularism তুর্কী গঠনের মধ্য দিয়ে মুসলিম বিশ্বে আনুষ্ঠানিকভাবে Secularism রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে রাষ্ট্রের যাবতীয় কার্যক্রমকে ইসলামমুক্ত করে তিনি ধর্মনিরপেক্ষতার গোড়াপত্তন করেন। আর পরবর্তী দশকগুলোতে মুসলিমবিশ্বের বিভিন্ন দেশ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে Secularism রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

সুতরাং মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগকে আল্লাহ ও রাসূলের প্রভাবমুক্ত রেখে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ধর্মকে পরিত্যাগ করাই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের মূল লক্ষ্য। এ মহান উদারতার খোলস পরেই মূলত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ইসলামের সাথে ঐতিহাসিক যুদ্ধে লিপ্ত। এই চিরন্তন লড়াই রাসূলে করীম (সা) এর সময়েও ছিল। যখন আল্লাহর নিকট থেকে প্রাপ্ত পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান মানব সমাজে কায়েমের আওয়াজ তুলেছেন ঠিক তখনই শাসকশ্রেণীর পক্ষ থেকে নানা অজুহাতে বিরোধীতা করা হয়েছে। হযরত ইব্রাহিম (আ)-এর সাথে নমরুদের, মুসা (আ)-এর সাথে ফেরাউনের এবং হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর সাথে আবু লাহাব-আবু জেহেলদের দ্বন্দ্ব ছিল চিরন্তন। আজও সেই লড়াই অব্যাহত রয়েছে এবং থাকবে। তাদের অনুসারীদের ভাষা এবং কৌশলের পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু ইসলামের উপর আঘাত হানছে সমান গতিতেই এবং আরো অতিমাত্রায়।

ইতিবাচক দিকসমূহ

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ পর্যালোচনার পর আমরা এর ভেতরে কতক আশাব্যঞ্জক দিক খুঁজে পাই। শিক্ষা সংস্কারের মাধ্যমে যুগোপযোগী একটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নের যে দাবি বহু দিন ধরে উত্থাপিত হচ্ছিল, তার অনেকখানি এ রিপোর্ট ধারণ করছে।

বিশেষ করে শিক্ষার কাঠামোগত সংস্কার সাধনের মাধ্যমে স্তরগত পুনর্বিন্যাস প্রবর্তন ছিল সময়ের দাবি। এর বাইরেও কতক বিষয় উঠে এসেছে, যা শিক্ষার মানোন্নয়নের মাধ্যমে একটি কল্যাণধর্মী উন্নত জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যেমন

• প্রাথমিক শিক্ষার প্রারম্ভে ১ বছর মেয়াদী প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালুকরণ।

• ৮ বছর মেয়াদী (১ম থেকে ৮ম শ্রেণী) বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালুকরণ।

• মাদরাসার মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে ব্যবসায় শিক্ষা শাখা সংযোজন।

• কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ।

• মাধ্যমিক স্তরে বাধ্যতামূলকভাবে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা অন্তর্ভুক্তকরণ।

• শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১:৩০ নির্ধারণ।

• প্রাথমিক স্তরে আদিবাসীসহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য স্ব-স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষণ-শিখন (teaching-learning)-এর ব্যবস্থা করা।

• সমমর্যাদাভুক্ত বা একীভূত শিক্ষাব্যবস্থা (inclusive education system) চালুকরণ।

• প্রচলিত বিভিন্ন ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বিরাজমান বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ।

• প্রাথমিক স্তরে (৩য় থেকে ৮ম শ্রেণী) ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা।

• শিক্ষার্থীদের শারীরিক শাস্তি সম্পূর্ণ বিলুপ্তকরণ।

• উচ্চ শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতির কারণে ন্যূনতম যোগ্যতার শর্ত শিথিল না করা।

• উচ্চ শিক্ষায় গবেষণাকে উৎসাহিত করা এবং এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কনসালটেন্ট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেয়া।

• সকল প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার স্থাপন।

• সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত নির্বাচনী পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী ভর্তি।

• জাতীয় শিক্ষানীতি নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের জন্য একটি স্থায়ী জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন।

• প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও বেসরকারি কলেজ পর্যায়ে শিক্ষকদের নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি ও প্রশিক্ষণের জন্য একটি স্বতন্ত্র শিক্ষক নির্বাচন ও উন্নয়ন কমিশন গঠন।

• প্রচলিত প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং সেন্টার নিয়ন্ত্রণ ও নিরুৎসাহিত করে ক্রমে এর অবসান।

• বিজ্ঞান ও প্রায়োগিক শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ।

• কওমী মদ্রাসাগুলোর জন্য পৃথক কওমী শিক্ষা কমিশন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ

কিছু মৌলিক সীমাবদ্ধতা ও আমাদের বক্তব্য

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ অনেক আশাব্যঞ্জক ও বাস্তবভিত্তিক হওয়ার পরও বিশেষ কতিপয় সীমাবদ্ধতার কারণে তা জাতীয় আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রয়োজনকে ধারণ করতে সক্ষম হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষানীতিতে স্ব-বিরোধিতা ফুটে উঠেছে। তাই এ শিক্ষানীাতিকে কোনোভাবেই পূর্ণাঙ্গ ও সর্বজনীন শিক্ষানীতি হিসেবে গণ্য করা যায় না। এর কারণগুলো নিম্নরূপ:

১।।

খসড়া রিপোর্টের শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অধ্যায়ের ৪, ৫ ও ১৪ নম্বর পয়েন্টে যথাক্রমে বলা হয়েছে,

“জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারা বিকশিত করে প্রজন্ম পরম্পরায় সঞ্চালনের ব্যবস্থা করা।”

“দেশজ আবহ ও উপাদান সম্পৃক্ততার মাধ্যমে শিক্ষাকে শিক্ষার্থীর চিন্তা-চেতনা ও সৃজনশীলতার উজ্জীবন এবং তার জীবন-ঘনিষ্ট বিকাশে সহায়তা করা। ”

“সকল শিক্ষার্থীর মধ্যে সম-মৌলিক চিন্তা-চেতনা গড়ে তোলা এবংজাতির জন্য সম-নাগরিক ভিত্তি সৃষ্টির লক্ষ্যে সব ধারার শিক্ষার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যবই বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো। একই উদ্দেশ্যে মাধ্যমিক স্তরেও একইভাবে কয়েকটি মৌলিক বিষয় পড়ানো।”

অথচ এ বিষয় বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়েছে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষার ক্ষেত্রে। ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাকে একটি বিদেশী ধারার শিক্ষা হিসেবে গণ্য করে একে বিশেষ শিক্ষা হিসেবে স্বীকৃতি ও পূর্ণ স্বাতন্ত্র্য দিয়ে সকল প্রকার পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ ও সংস্কার আওতার বাইরে রাখা হয়েছে।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়ায় অন্য সব বিষয়ের ব্যাখ্যায় পৃথক পৃথক অধ্যায় রাখা হলেও দেশের ক্রমবর্ধমান ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাধারা সম্পর্কে কয়েক বাক্যেই সমাপ্ত করা হয়েছে। অথচ এখানে অধ্যয়ন করছে এ দেশেরই বিপুল সংখ্যক ছেলে-মেয়ে। আবার এ শিক্ষাধারায় এদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ছোঁয়াও নেই।

বাস্তবতা হলো, এদেশীয় বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, রুচি ও সংস্কৃতির সাথে পরিচয় না থাকায় ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরাই এদেশে অন্য একটি sub-culture গড়ে তুলছে যা আমাদের সমাজের সাথে খাপ খায় না। তারা বেড়ে ওঠে একটি বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠী হিসেবে, যা জাতিগত ঐক্য ও চেতনার পরিপন্থী।

সম-মৌলিক চিন্তা-চেতনা গড়ে তোলা ও সম-নাগরিক ভিত্তি সৃষ্টির পাশাপাশি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা ও common set of cultural values প্রবর্তনের স্বার্থেই ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাধারাসহ প্রত্যেক ধারার সকল শিক্ষার্থীরই আমাদের জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা জরুরি। তাই ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাধারাসহ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার প্রত্যেক ধারাকেই সরকারি পরিবীক্ষণ ও নিরীক্ষার আওতায় আনতে হবে। আমরা মনে করি, বর্তমান ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাধারাকে বিদেশীদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে এর শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিতে সংস্কার সাধন করতে হবে। এক্ষেত্রে তাদের জন্য জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত শিক্ষাক্রমের ইংরেজি সংস্করণ (national curriculum in English version) অনুসরণ করা যেতে পারে।

২।। 

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ চূড়ান্ত খসড়া-২০০৯ এর সংযোজনী ৩-এর নম্বর বন্টন অধ্যায়টি না থাকায় নবম ও দশম শ্রেনীতে ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক আছে কি নাই তা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। কারন খসড়া শিক্ষানীতির মাধ্যমে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বাতিল করা হয়েছে। বর্তমানে চুড়ান্ত শিক্ষানীতির মাধ্যমিক অধ্যায়ের পৃষ্ঠা ১২তে শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তুক শিরোনামে বলা হয়েছে-সাধারণ, মাদ্রাসা এবং কারিগরি সকল ধারায় বাংলা, ইংরেজী,বাংলাদেশ স্টাডিজ, সাধারণ গণিত এবং তথ্য প্রযুক্তি বাধ্যতা মূলক হিসেবে থাকবে। এখানে ধর্মের উল্লেখ নেই। অথচ জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে,

“শিক্ষানীতির মূল উদ্দেশ্য মানবতার বিকাশ এবং জনমুখী উন্নয়নে ও প্রগতিতে নেতৃত্বদানের উপযোগী মননশীল, যুক্তিবাদী, নীতিবান, নিজের এবং অন্যান্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কুসংস্কারমুক্ত, পরমতসহিষ্ণু, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমিক এবং কর্মকুশল নাগরিক গড়ে তোলা”।

আমরা উপর্যুক্ত মূল উদ্দেশ্য হাসিলের স্বার্থেই প্রত্যেক শিক্ষাধারার সকল স্তরের সকল শাখা ও বিভাগে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাকে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জোর দাবি জানাচ্ছি।

শিক্ষা-মনোবিজ্ঞানের আলোকে বলা যায়, সাধারণত মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের বয়ঃক্রম হলো নানাবিধ টানাপোড়নের সময়।এ বয়সে মনো-দৈহিক বিশেষ পরিবর্তনের ফলে তারা বিপথে পা বাড়ায়, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফলে এ সময়টাতে খুব সহজেই বিকৃতি আর অনাচার বাসা বাঁধে তাদের মনে। এ থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন আত্ম-নিয়ন্ত্রণ। ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাই ব্যক্তিকে তার চিন্তা-চেতনা, কর্মকাণ্ড ও আচার-আচরণে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সুপথে পরিচালনা করে। ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের অভাবই ব্যক্তিকে অন্তঃসারশূন্য করে দেয়। ফলে সে নানা রূপ অপরাধ, দুর্নীতি ইত্যাদিতে জড়িয়ে পড়ে। আমাদের আজকের সমাজবাস্তবতা তারই প্রমাণ। কারণ, আমাদের ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অপ্রতুলতা আমাদের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হচ্ছে না। তাই আজকের উত্তপ্ত পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে সব স্তরের জন্যই ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সাধারণ শিক্ষাধারার প্রাথমিক স্তরের তৃতীয় শ্রেণী থেকে ১০০ নম্বরের ধর্ম শিক্ষা রাখা হয়েছে, যা খসড়া রিপোর্ট অনুযায়ী গল্প ও জীবনীর মাধ্যমে শেখানো হবে। এটা ধর্ম শিক্ষার একমাত্র পদ্ধতি নয়। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা যাতে বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারে এরূপ অনুশীলনমূলক অন্যান্য শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতিও অনুসরণ করতে হবে। দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত ধর্ম শিক্ষা না রেখে ললিতকলা শিক্ষা অর্ন্তভুক্ত করার পেছনে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়া রিপোর্ট এবং শিক্ষামন্ত্রী ও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির কোনো কোনো সদস্যের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট যে, তাঁরা ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা চালু ও শিক্ষার্থীদেরকে ধর্মীয় শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রাখার পাঁয়তারা করছেন। আমরা বিশ্বাস করি, শিক্ষামন্ত্রী ও জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ প্রণয়ন কমিটির সদস্যবৃন্দসহ এ প্রস্তাবের সমর্থক সকলেই প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। তাঁরা অবশ্যই ব্যক্তিক বিকাশে নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব অস্বীকার করবেন না।

নৈতিকতার মূল ভিত্তি হলো, অতিপ্রাকৃতিক শক্তি তথা সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস। এ বিশ্বাসই ব্যক্তিমানুষকে তাঁর আদেশ ও নিয়ম অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করে, কু-কর্মের শাস্তি সম্পর্কে অবহিত করে এবং ভালো কাজের জন্য পুরস্কৃত করে। মূলতঃ নৈতিক মূল্যবোধের জাগরণ ও পরিস্ফুটন ব্যাতীত একটি সুশৃঙ্খল ও কল্যাণকর মানবসমাজ কল্পনা করা যায় না। আজকের বিশ্বজুড়ে চলমান অরাজকতা ও অশান্তির মূল কারণও এ নৈতিক শিক্ষার অভাব। আর নৈতিক শিক্ষার মূল বিষয়টি ধর্মীয় শিক্ষা থেকে উৎসারিত। পৃথিবীর সকল ধর্মই মানুষের মঙ্গলের কথা বলে, আত্মার পরিশুদ্ধির কথা বলে, ন্যায়-অন্যায় বোধের শিক্ষা দেয়। আর এসবই নৈতিক শিক্ষার সমন্বয়। তাহলে কি ধর্মীয় শিক্ষা ব্যাতীত নৈতিক শিক্ষা অর্জন করা যায় না? হয়তো যায়; কিন্তু তা ভঙ্গুর ও বিক্ষিপ্ত। নৈতিক শিক্ষার এসব বিক্ষিপ্ত স্রোতের আদি উৎসও বিভিন্ন ধর্ম। ধর্মীয় মূল্যবোধই এর মূল স্রোত। ধর্মীয় স্রোতবিহীন নৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি দেয়াল থেকে যায়। ধর্মীয় শিক্ষার বাইরে যে নৈতিক শিক্ষা তাতে ব্যক্তি নিজের কাছে তার দায়বদ্ধতার কারণে নীতি মেনে চলে। ফলে ব্যক্তি যেকোনো দুর্বল মুহূর্তে প্রলোভনে পড়ে কিংবা মানবিক দুর্বলতার কারণে তার নৈতিক গণ্ডির বাইরে চলে যেতে পারে। তাছাড়া এখানে ব্যক্তি সৎ থাকার, নৈতিক আচরণে অটল থাকার কোনো কারণ খুঁজে পায় না। নশ্বর এই পৃথিবীতে ভোগ-বিলাস ও আরাম-আয়েশের মধ্য দিয়ে জীবন কেটে গেলেই হলো। তাতে কারো ক্ষতি কি উপকার হলো তা দেখার প্রয়োজনই বা কিসের। দুনিয়ার সময়টুকু যেকোনো উপায়ে পার করতে পারলেই হলো। ব্যস খালাস!

একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের ধর্মসমূহ ও ধর্মীয় বিশ্বাস হচ্ছে সামাজিক উপাদানসমূহের একটি যৌগিক সমন্বয়। ধর্ম ও নৈতিকতা পরস্পর অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। এদের অবস্থান সর্বদাই পাশাপাশি। মূলত নৈতিকতার উৎপত্তি ধর্মের এমন জায়গা থেকে, যা কখনও আলাদা করার মতো নয়। নৈতিকতা মানুষের একটি সহজাত বিষয়। বয়সের সাথে সাথে এটা বিকশিত হয়ে কিছু বিষয়কে গ্রহণ এবং কিছু বিষয়কে বর্জন করে একটা মানদণ্ডে পৌঁছায়, যাকে আমরা মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে নৈতিক মানদণ্ড বলি। মানুষে মানুষে এ আচরণের ভিন্নতা লক্ষ করা যায়। এসব কারণেই মানুষের বিবেক কিছু নৈতিক গুণাবলিকে ভালো বলে স্বীকৃতি দেয় এবং কিছু বিষয়কে মন্দ বলে প্রত্যাখ্যান করে।

ধর্মীয় শিক্ষার সকল বিষয়ই স্রষ্টা-কেন্দ্রিক। এখানে মানুষের সকল কাজ-কর্ম স্রষ্টার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য উৎসর্গীকৃত। এ পৃথিবীই শেষ নয়; পৃথিবীর জীবন শেষ হলে আছে আরেক অনন্ত জীবন। সে জীবনের ভালো-মন্দ সবকিছু নির্ভর করে পৃথিবীতে ব্যক্তির কৃত সকল কাজ-কর্মের উপর। ফলে সেই অনন্ত জীবনের প্রতি বিশ্বাস থেকে এর সাফল্যের জন্য ব্যক্তি নিজেকে ভালো কাজে নিয়োজিত রাখে; মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকে। ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী ব্যক্তি মাত্রই বিশ্বাস করেন যে, স্রষ্টা সর্বদ্রষ্টা; প্রতিটি ভালো ও মন্দ কাজের তিনি সাক্ষী এবং সকল কাজ-কর্মের জন্য পরকালীন জীবনে স্রষ্টার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এ বিশ্বাসের কারণেই ব্যক্তি সবচেয়ে গোপন ও নিরাপদ জায়গাতেও শত প্রলোভন সত্ত্বেও অনৈতিক কোনো কাজে জড়িত হতে পারে না; কিন্তু এ বিশ্বাসের বীজ যার হৃদয়ে বপিত হয় নি তার কাছে নৈতিকতা অর্থহীন মনে হয়। ফলে তাকে শত নৈতিক শিক্ষা দেয়া হলেও তা বিস্মৃত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, ব্যক্তিক ও সামষ্টিক কল্যাণের জন্য প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষা তথা ধর্মীয় শিক্ষা।

এখানে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, আচ্ছা, বেশ ভালো কথা! মানলাম, ধর্মীয় শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে; কিন্তু তা তো পারিবারিক পরিবেশেই দেয়া যায় কেন এটি আবার আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষাক্রমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। হ্যাঁ, উপর্যুক্ত আলোচনার মাধ্যমে এটি স্পষ্ট ও প্রমাণিত হয়েছে যে, ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষা সবার জন্য প্রয়োজনীয় এবং অতি আবশ্যক একটি বিষয়, যা কোনোভাবেই বাদ দেয়া যায় না। ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষাবিবর্জিত সর্বোত্তম শিক্ষাক্রমও যে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে তা আমাদের সামনে আজ সুস্পষ্ট। ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষা থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণেই আজ জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার প্রতিযোগিতা, জালিয়াতি-কালোবাজারির ছড়াছড়ি। সুতরাং বেঁচে থাকার জন্য যেমন মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন, তেমনি সেই মানুষগুলোকে সত্যিকার অর্থে আলোকিত মানুষ ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন ধর্মীয় শিক্ষা তথা নৈতিক শিক্ষা। আর এর আয়োজন রাষ্ট্রকেই করতে হবে সর্বজনীন প্রয়োজনের ভিত্তিতে। কেননা, অনেক পরিবারের পক্ষে পৃথকভাবে এর ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়। তাছাড়া এটি শিশুর অধিকার। সুতরাং মা-বাবার অনিচ্ছা বা অলসতার কারণে যেন শিশু এ অধিকার হতে বঞ্চিত না হয়, সেজন্যই প্রয়োজন ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষাকে অন্যান্য জাগতিক শিক্ষার সাথে বাধ্যতামূলকভাবে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করা।

ব্যক্তির অর্জিত জ্ঞান অনুযায়ী মানস গঠনের উপযুক্ত সময় শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর। এ সময় শিশুকে যেভাবে শিক্ষা দেয়া হবে সেভাবে তার মানসজগৎ গঠিত হবে; শিশুর গন্তব্যও সেদিকেই নির্ধারিত হবে। আমরা সবাই চাই, আমাদের শিশুরা জ্ঞানে-গুণে, যোগ্যতা-দক্ষতায় হোক অনন্য। সেই সাথে এ-ও চাই যে, তারা তাদের সেই জ্ঞান ও দক্ষতার কল্যাণকর ব্যবহার নিশ্চিত করুক। আর এর জন্য যে উদ্দীপক দরকার তা সরবরাহ করবে ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষা।

এ জন্যই পারমাণবিক বোমা আবিষ্কারের পর The Philosophy of the Modern Education গ্রন্থে অধ্যাপক বার্বাস বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উপর জোর দিয়ে বলেছেন,

“বাধ্যতামূলকভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার অনুশীলন না করলে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। কারণ, মানুষ ধ্বংসের উপকরণ অনেক বেশি জোগাড় করে ফেলেছে।”

৩।।

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এ মাদ্রাসা শিক্ষা ধারার ইবতেদায়ী(প্রাথমিক)স্তরের পাঠ্যসূচি নিয়ে রহস্য দেখা দিয়েছে। চুড়ান্ত খসড়ানীতি-২০০৯এ শিক্ষানীতির যে সব বিষয়গুলো আপত্তিকর হিসেবে বিবেচিত হয় তার মধ্যে মাদ্রাসা শিক্ষার পাঠ্যসূচি ব্যাপকভাবে কমিয়ে সাধারণ শিক্ষা চালুর প্রস্তাব অন্যতম। কিন্তু গৃহীত চুড়ান্ত শিক্ষানীতিতে সংযোজনী-২এর মানবন্টন অধ্যায়টি না থাকায় এসব বিতর্কিত বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা অস্পষ্ট।

আমরা মাদরাসা শিক্ষাধারার ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) স্তরের শিক্ষাক্রমে কতিপয় সংশোধনী আনার দাবি জানাচ্ছি।

(ক) মাদরাসা শিক্ষাধারার ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) স্তরে যেসব বিষয় অতিরিক্ত হিসেবে দেখানো হয়েছে, সেগুলো মাদরাসা শিক্ষাধারার স্বকীয়তা রক্ষার স্বার্থে মাদরাসার জন্য আবশ্যিক হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।

(খ) ১ম ও ২য় শ্রেণীতে কুরআন মাজীদ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

(গ) ৩য় থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত যেহেতু আকাইদ ও ফিক্হ এবং কুরআন মাজীদ ও তাজবিদ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, সেহেতু একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তির কারণে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বিষয়টি বাদ দিতে হবে।

(ঘ) ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত আরবিতে ১০০ নম্বরের পরিবর্তে আরবি ১ম পত্র ১০০ নম্বর ও আরবি ২য় পত্র ১০০ নম্বর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

৪।।

জাতীয় শিক্ষানীতি -২০১০এ মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যসূচি নিয়েও রহস্য ও বিভ্রান্তি রয়েছে। তার মূল কারণ খসড়া শিক্ষানীতির ন্যায় চুড়ান্ত শিক্ষানীতিতে পাঠ্যসূচি সম্বলিত সংযোজনী-৩ অন্তর্ভূক্ত না করা। আর এর মাধ্যমে যদি খসড়া শিক্ষানীতির প্রদত্ত বিষয়গুলো বাস্তবায়ন উদ্দ্যেশ্য হয়ে থাকে তবে মাদ্রাসা শিক্ষা মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এইখানে তাই খসড়া শিক্ষানীতির অবস্থান তুলে ধরা হলোঃ

খসড়া রিপোর্টের সংযোজনী ৩-এ উল্লিখিত মাদরাসা শিক্ষাধারার মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রমে কতিপয় মৌলিক বিষয়কে সংকোচন/পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে কিংবা ঐচ্ছিক হিসেবে রাখা হয়েছে অথবা সম্পূর্ণরূপে বাদ দেয়া হয়েছে। যার ফলে মাদরাসা শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল বাধাগ্রস্ত হবে এবং এর মৌলিকত্ব ও স্বাতন্ত্র্য থাকবে না। উল্লেখ্য, এ কথা সর্বজনবিদিত এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া)-এর ২৭ পৃষ্ঠায় মাদরাসা শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে,

“শান্তির ধর্ম ইসলামের প্রকৃত মর্মার্থ অনুধাবনে সক্ষম করে গড়ে তোলা, তারা এমনভাবে তৈরি হবে যেন তারা ইসলামের আর্দশ ও মর্মবাণী ভাল করে জানে ও বুঝে, সে অনুসারে নির্ভরযোগ্য চরিত্রের অধিকারী হয় এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে সেই আদর্শ ও মূলনীতির প্রতিফলন ঘটায়।”

নিম্নে খসড়া রিপোর্টের সংযোজনী ৩-এর আলোকে মাদরাসা পাঠ্যক্রমের বাতিলকৃত/সংকুচিত/পুনরাবৃত্তিকৃত চিত্র দেখানো হলোÑ

মুজাব্বিদ মাহির শাখা বাতিল করা হয়েছে আলিম হিফজুল কুরআন ও মুজাব্বিদ মাহির শাখা বাতিল করা হয়েছে দাখিল ১০০ নম্বরের আরবি বাতিল করা হয়েছে (বিজ্ঞান) দ্বাদশ-একাদশ ১০০ নম্বরের ফিক্হ বাতিল করা হয়েছে হয়েছে০ নম্বরের স্থলে ২০০ নম্বর করা বালাগাত ও মানতিক ১০ (মানবিক) দ্বাদশ-একাদশ ইসলামের ইতিহাস ১০০ নম্বরের স্থলে ২০০ নম্বর করা হয়েছে আরবি ২০০ নম্বরের স্থলে ১০০ নম্বর করা হয়েছে হয়েছে ২০০ নম্বরের স্থলে ১০০ নম্বর করা ফিক্হ ও উসূলে ফিক্হ নম্বরের স্থলে একত্রে ১০০ নম্বর করা হয়েছে২০০করে হাদীস এবং ফিক্হ ও উসূলে ফিক্হ পৃথকভাবে ১০০ নম্বর (বিজ্ঞান) ১০ম-৯ম মানতিক (ঐচ্ছিক) বাতিল করা হয়েছে (মানবিক) ১০ম-৯ম ১০০ নম্বর)বিষয় হিসেবে হাদীস ১০০ নম্বর এবং ফিক্হ ও উসূলে ফিক্হ বিষয় হিসেবে হাদীস ও ফিক্হ ১০০ নম্বর, আবার নৈর্বাচনিক পুনরাবৃত্তি করা হয়েছে (আবশ্যিক এর ক্ষেত্রে-হহাদীস ও ফিক্ আরবি ২০০ নম্বরের স্থলে ১০০ নম্বর করা হয়েছে ঐচ্ছিক করা হয়েছেইসলামের ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান আবশ্যিক বিষয় থেকে আরবি ২০০ নম্বরের স্থলে ১০০ নম্বর করা হয়েছে ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম কুরআন মাজীদ বাতিল করা হয়েছে ১ম ও ২য় কাচন/পুনরাবৃত্তি করা হয়েছেবাতিল/সংবের্তমানে পঠিত যেসব মৌলিক বিষয় খসড়া রিপোর্টে শ্রেণী

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯-এর চূড়ান্ত খসড়ায় একদিকে বলা হয়েছে যে মাদরাসা শিক্ষাধারার স্বকীয়তা রক্ষা করা হবে, অন্যদিকে খসড়া রিপোর্টে প্রস্তাবিত শিক্ষাক্রমে এর মৌলিকত্ব ও স্বাতন্ত্র্যের উপর অপরিণামদর্শী হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। এর কারণ হলো, জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটি মাদরাসা শিক্ষাধারা সম্পর্কে অভিজ্ঞ কারো সাথে আলাপ-আলোচনা করে নি। মাদরাসা শিক্ষাধারা সম্পর্কে অভিজ্ঞদর সাথে আলোচনা করে সময়ের চাহিদার আলোকে এর স্বকীয়তা বহাল রেখে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করার জন্য আমরা জোর দাবি জানাচ্ছি।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ভারতের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে দেওবন্দ মাদরাসা, সাহারানপুর মাদরাসা এবং একই ধরনের আরো বিখ্যাত কতিপয় মাদরাসা তাদের নিজস্ব প্রশাসনিক ব্যবস্থা, পাঠ্যসূচি ও টেক্সট চালু রেখেছে; এবং সরকার কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ ছাড়াই তাদের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। এমনকি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের নির্ধারিত যোগ্যতার মানদণ্ডের ভিত্তিতে সকল ধারার শিক্ষার্থীকে ভর্তির সুযোগ প্রদান করে। (এক্ষেত্রে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট www.jnu.ac.in ভিজিট করা যেতে পারে।)

এছাড়া পশ্চিমা অনেক উন্নত দেশে সনাতন শিক্ষাব্যাবস্থা রয়েছে, যা তাদের নিজস্ব ধারায় পরিচালিত এবং স্বীকৃত। সুতরাং আমরা মাদরাসা শিক্ষাক্রমে এর মৌলিক বিষয়গুলোকে অন্তর্ভুক্ত রেখে পুনরায় শিক্ষাক্রম প্রণয়নের জোর দাবি জানাচ্ছি।সেই সাথে বর্তমান শিক্ষানীতিতে মাদ্রাসা পাঠ্যসূচি বিস্তারিত প্রনয়ন করে স্পষ্ট ও সন্দেহ মুক্ত করার দাবী জানাচ্ছি।

৫।। 

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০এর ৩৯ নং পৃষ্ঠায় নারী শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে বলা হয়েছে,

“নারীকে সচেতন ও প্রত্যয়ী করা, এবং সম-অধিকারের অনুকূলে নারীর দৃষ্টিভঙ্গি প্রখর করা।”

এ প্রসঙ্গে আমরা বলতে চাই যে শুধু দৃষ্টিভঙ্গি প্রখর করলেই হবে না, নারীর স্বকীয়তা বজায় রেখে তাদের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

৬।। 

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০এর ৪০ নং পৃষ্ঠায় নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করার জন্য বলা হয়েছে,

“উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ ও গবেষণা করার জন্য দরিদ্র ও মেধাবী ছাত্রীদের বিশেষ বৃত্তির ব্যবস্থা এবং সুদ মুক্ত/স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে।”

আমাদের সমাজবাস্তবতায় দেখা যায়, সুদের চক্রবৃদ্ধি হারের কারণে ঋণগ্রহীতার পক্ষে আসল ফেরত দেয়া সম্ভব হয় না এবং এটা ঋণগ্রহীতার জন্য ক্রমবর্ধমান বোঝা হিসেবে বিবেচিত। ফলে ইচ্ছা থাকলেও এ ধরনের ঋণ গ্রহণে শিক্ষার্থীরা আগ্রহী হবে না। তাই শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহী করতে শিক্ষা বৃত্তি প্রদানের পাশাপাশি সুদমুক্ত উত্তম ঋণ (করজে হাসানা) প্রদান করতে হবে। শিক্ষা সাথে সুদের মত অনৈতিক বিষয়কে জড়ানো সম্পুর্ণ পরিহার করতে হবে।

৭।। 

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০এর ৪১ নং পৃষ্ঠায় ললিতকলা শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে,

“সরকারি উদ্যোগে ও অর্থানুকূল্যে জাতীয় চিত্রশালা, সংগীত, ও নৃত্য অ্যাকাডেমি, নাট্য ও রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করা বাঞ্ছনীয়।”

এ সম্পর্কে একই পৃষ্ঠায় আরো বলা হয়েছে,

“সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শহর ও গ্রাম পর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ চিত্রকলা ও কারুশিল্পের প্রদর্শনী, সংগীত, নাটক নৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে হবে।”

আমরা এ প্রসঙ্গে বলতে চাই যে ললিতকলা শিক্ষা কার্যক্রমসমূহ প্রত্যেক ধর্মের ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ করে সুস্থ, সুন্দর ও মৌলিক সংস্কৃতি বিকাশের লক্ষ্যে পরিচালিত হতে হবে যা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

৮।। 

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর ৪৫ নং পৃষ্ঠায় ব্রতচারী কার্যক্রমকে নীতিগতভাবে স্বীকৃতি দেয়া ও আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করার সুপারিশ করা হয়েছে। ব্রতচারীর পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে,

“এটি গীত ও নৃত্য-ভিত্তিক সুশৃঙ্খল একটি কার্যক্রম যা বিদ্যালয়ে বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান হিসেবেও বিবেচনা করা যায়। … ব্রতচারী কার্যক্রম সিলেট, খুলনা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ এবং জয়পুরহাটের অনেক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রচলিত আছে।”

ব্রতচারী কার্যক্রম কোনোভাবেই ঢালাওভাবে আমাদের বিদ্যালয়সমূহে চালু করার মতো বিষয় নয়। এটি কোনো সর্বজনীন, স্বীকৃত ও নীতিগতভাবে গ্রহণযোগ্য কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল আচার-প্রথাও নয়; বরং এটি একটি আঞ্চলিক গোষ্ঠীগত প্রথা। এরূপ গোষ্ঠীগত (local) কোনো চর্চাকে সাধারণভাবে (universally) উৎসাহিত কিংবা চালু করা শুধু অযৌক্তিকই নয়, বরং মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। ব্রতচারীর মূল উদ্দেশ্য হিসেবে যা বলা হয়েছে, তা স্কাউটিং ও গার্লস গাইডিং এবং ক্রীড়া শিক্ষার কার্যক্রম শক্তিশালী করার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব বলে আমরা মনে করি।

কিছু সুপারিশ 

জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিবেচনা করার জন্য নিম্নে কিছু সুপারিশ পেশ করা হলো। যেহেতু মুখবন্ধে বলা হয়েছে শিক্ষানীতি কোন অপরিবর্তনীয় জিনিস নয় এর পরিবর্তন ও উন্নয়নের পথ সবসময় উন্মুক্ত থাকবে কোন ভুল ত্রুটি হলে তা সংশোধন করা যাবে। শিক্ষা একটি গতিশীল বিষয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নয়নের সঙ্গে সংগতি রেখে সবসময়েই এর পরিবর্তন বা আধুনিকীকরণ অব্যাহত থাকবে। বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যেই বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অব্যাহত উন্নয়ন ও প্রয়োগের অভিজ্ঞতা শিক্ষানীতিকে অব্যাহতভাবে সমৃদ্ধ করবে।

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে আমাদের দেশে সাক্ষরতার হার মাত্র ৪৯%। নিরক্ষরদের অধিকাংশই আবার বয়স্ক। দেশের অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠীকে নিরক্ষর রেখে উন্নত ও স্বনির্ভর জাতি গঠন সম্ভব নয়। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এ বয়স্ক সাক্ষরতার কথা বলা হলেও এর পূর্ণ সাফল্যের জন্য কোনো সুস্পষ্ট রোডম্যাপ না থাকায় আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব পেশ করছি দেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরক্ষরতা দূর করে শত ভাগ সাক্ষর জাতি হিসেবে পথ চলার লক্ষ্যে এবং সাংবিধানিক (১৭ নং অনুচ্ছেদ) দায়বদ্ধতা পূরণার্থে উচ্ছশিক্ষা স্তরে (সকল পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজসমূহ ও মেডিক্যাল কলেজসমূহে) নিদিষ্ট সময়ের জন্য summer/winter schooling program প্রবর্তন করা যেতে পারে। এ program-এর আওতায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীরা সরকারি ব্যবস্থাপনায় নির্দিষ্ট সম্মানীর বিনিময়ে বাধ্যতামূলকভাবে সাক্ষরতা অভিযানে অংশগ্রহণ করবেন। এ অভিযানে অংশগ্রহণ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য অ্যাকাডেমিক ক্রেডিট হিসেবে বিবেচিত হবে।

•সমকালীন প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকার প্রয়োজনে উচ্চশিক্ষা স্তরে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে medium of instruction হিসেবে ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করা বাঞ্ছনীয় বলে আমরা মনে করি।

•মাতৃভাষায় জ্ঞানচর্চা উৎসাহিত ও গবেষণাকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি এতে উন্নত যোগ্যতা সৃষ্টির লক্ষ্যে উচ্চশিক্ষা স্তরে বাধ্যতামূলক বাংলা সংযোজন করা সময়ের দাবি।

•অনার্স পর্যায়ে ভর্তির ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বের ন্যায় বিগত স্তরের শিক্ষাধারা ও ফলাফলের চেয়েও উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বাস্তব যোগ্যতার বিচারকেই মুখ্য করে তোলা উচিত। এক্ষেত্রে IELTS, TOEFL, GRE-এর মতো প্রামাণিক মানসম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য অভীক্ষা (standard & reliable test) চালু করা যেতে পারে।

• জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর ৭নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “মেয়ে শিক্ষার্থীরা যেন বিদ্যালয়ে কোনোভাবে উত্যক্ত না হয় সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।”

• এক্ষেত্রে মেয়ে শিক্ষার্থীদেরকে উত্যক্তকারীর জন্য শাস্তির বিধান রাখার পাশাপাশি আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে শালীন ও মার্জিত মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি সর্বজনীন ড্রেস কোড প্রবর্তন করা যেতে পারে।

• জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০এর ৩৯ নং পৃষ্ঠায় নারী শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের ৫ নং ক্রমিকে বলা হয়েছে, “প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের পাঠ্যসূচিতে নারীর ইতিবাচক ও প্রগতিশীল ভাবমূর্তি ও সমান অধিকারের কথা তুলে ধরা হবে এবং ইতিবাচক দিকগুলো পাঠ্যসূচিতে আনতে হবে, যাতে নারীর প্রতি সামাজিক আচরণের পরিবর্তন হয়।”

আমরা মনে করি, নারীর প্রতি সামাজিক আচরণের পরিবর্তন আনয়নের জন্য সকল প্রকার গণমাধ্যমে নারীকে পণ্যরূপে উপস্থাপন বন্ধ করতে হবে; আকাশ সংস্কৃতিকে সর্বজনীন শালীনতা, স্বকীয়তা ও আমাদের মূল্যবোধের মানদণ্ডে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে; ইন্টারনেটে পর্নোগ্রাফির ওয়েবসাইটসমূহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে।

• শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ ধারার ছাত্ররাজনীতি প্রবর্তন করতে হবে। ছাত্ররাজনীতির নামে অ-ছাত্রদের রাজনীতি, চাঁদাবাজি ও সাধারণ ছাত্রদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি এবং সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় নয় বরং যোগ্যতাকেই একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কোমলমতি ছাত্রদের ক্ষমতার সিড়ি ও পতিপক্ষকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। বিদেশে মেধা পাচার বন্ধ করা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পরিবর্তন বন্ধ করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় মন্ত্রী-এমপি ও নেতা-নেত্রীদের অনৈতিক ও অবৈধ হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্রসংসদ সচল করতে হবে। শিক্ষানীতিতে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট ও বাস্তবসম্মত দিকনির্দেশনা অন্তর্ভুক্ত করা বাঞ্ছনীয় বলে আমরা মনে করি।

• জাতীয় শিক্ষানীতির ২০১০ এর সামগ্রিক পরিচালন, নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসন কাঠামোতে অতিরিক্ত কেন্দ্রীয়করণ (centralization) প্রবণতা লক্ষণীয়, যা দুর্নীতি ও অস্থিরতা বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখা প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।

• সাধারণ শিক্ষাধারার মাধ্যমিক স্তরে ঐচিছক বিষয় তালিকায় আরবির পাশাপাশি সংস্কৃত ও পালি রাখা হয়েছে। একই সাথে আমাদের এ অঞ্চলের ইতিহাসের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত এবং চলমান বিশ্বের সাথে সম্পর্ক বিচারে ফ্রেঞ্চ অথবা স্প্যানিশ ও ফার্সি বিবেচনা করা যেতে পারে।

• সামগ্রিকভাবে প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি দ্বিভাষী (bilingual) নীতি তথা ইংরেজি বনাম বাংলা গ্রহণ করেছে, যা মূলত উপনিবেশিক শাসনামলের ফল। একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন ও বহুমাত্রিক চেতনাসম্পন্ন জাতি গঠনে এ থেকে বেরিয়ে এসে বহুভাষী (multilingual) নীতি গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে এবং সময়ও হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রধান আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মর্যাদা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আদলে মাধ্যমিক স্তরে পর্যায়ক্রমে দেশের ইতিহাস ও চলমান বিশ্বের সাথে সঙ্গতি রেখে একটি তৃতীয় ভাষা নেয়ার অপশন চালু করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে আরবি ভাষা অগ্রাধিকার বিবেচনার দাবি রাখে। কেননা, বর্তমানে আরব দেশগুলো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত বাংলাদেশিদের জন্য শ্রমবাজারে উর্বর কর্মক্ষেত্র হিসেবে স্বীকৃত।

• শিক্ষানীতি সম্পর্কে শেষ যে কথাটি না বললেই নয় স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকেই শিক্ষা নিয়ে আমাদের দেশে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত ৩টি শিক্ষা কমিশন, ২টি অন্তর্বর্তীকালীন কমিশন, ২টি শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি এবং কতক শিক্ষা সংস্কার কমিটি গঠন করা হলেও এর কোনোটিই এ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয় নি। এর মধ্যে বিভিন্ন সময় নিত্য-নতুন তত্ত্ব ও পদ্ধতি যেমন ১৯৯২ সালে নৈর্ব্যক্তিক পদ্ধতি, ২০০১ সালে গ্রেডিং পদ্ধতি, ২০০৬ সালে একমুখী শিক্ষা, ২০০৯ সালে কাঠামোবদ্ধ (সৃজনশীল) প্রশ্নপদ্ধতির মতো বহুবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানানো হচ্ছে। ফলে এর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠছে আর অভিভাবকগণ দিশেহারা ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ছেন। সরকার পরিবর্তনের সাথে শিক্ষাপদ্ধতিতে ও পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আসছে। এক সরকার কোনো একটি পদ্ধতি চালু করে তো অন্য সরকার এসে তা বাদ দিয়ে নতুন পদ্ধ.তি চালু করে; তাদের মতবাদ পাঠ্যবিষয়ে অন্তর্ভুক্ত করে। ফলে শিক্ষার্থীরা হয় বিভ্রান্ত। তারা কোনটা বিশ্বাস করবে? আজ যেটা আছে তো কাল সেটা পাল্টে গেল। ফলে শিক্ষার্থীরা কোনো বিষয়ে স্থির হতে পারছে না; তাদের শিক্ষার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হচ্ছে। অথচ শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক যে সমস্যা তা সমস্যাই রয়ে গেছে।

আমরা কি এটাই চাই? আমরা কি চাই আমাদের শিশুরা বেড়ে উঠুক বিভ্রান্তির ঘূর্ণাবর্তের মধ্য দিয়ে? ভুল ইতিহাস আর দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে হোক দ্বিধান্বিত? তারা একটি বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার যাঁতকালে পিষ্ট হোক? ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষাবিবর্জিত হয়ে তারা ডুবে যাক দুর্নীতি, অন্যায় আর পাপ-পঙ্কিলতার পাকে?

আমরা তা চাই না। আমরা চাই না আমাদের শিশুরা গিনিপিগ হোক। আমরা চাই আমাদের সব শিশু বেড়ে উঠুক সমান সুযোগ-সুবিধার মধ্য দিয়ে; কোনো দলীয় মতবাদ নয়, তারা জানুক ইতিহাসের সত্যকে; বাস্তবিক ও ধর্মীয়-নৈতিক শিক্ষার সমন্বয়ে গড়ে উঠুক তাদের মন ও মানস, যার মধ্য দিয়ে অঙ্কুরোদ্গম ঘটবে মানবিক মূল্যবোধ, আত্মিক পরিশুদ্ধি আর পারস্পরিক কল্যাণবোধের। আশা করি আমাদের সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে এসব বিষয়গুলো পুনরায় বিবেচনা করে সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন।

এদেশের মানুষের চিন্তা-চেতনা আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতি সম্মান রেখে বর্তমান সরকার মেধা ও নৈতিকতার সমন্বয়ে নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে একটি সার্বজনিন শিক্ষা-ব্যবস্থা প্রণয়ন করবে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *